শেখর স্যারের সাথে পরিচয় আসলে ঝাড়গ্রামের সূত্রে৷ তখন মাস্টার্স করছি ওখানে। স্যারের লেখাপত্র পড়েছি কিন্তু জানতাম না উনি আমার কলেজেরই অধ্যাপক। তারপর আমার ঘোরাঘুরির জন্য বিভিন্ন সময় পরামর্শ নিতে হয়েছে।
শারদীয়া আনন্দবাজার ১৪২৭ এ উপন্যাস তালিকায় শেখর মুখোপাধ্যায় নামটা দেখে তাই অপেক্ষা করতে পারিনি। হাতে পাওয়া মাত্রই শুরু করে দিই। বেশ বড়ো উপন্যাস এবং খুব সহজ নয় আবার! তার সবচেয়ে বড়ো কারণ চরিত্রের ভিড়…! অনেক কিছুই জীবনে অপাঠ্য আমার, তবুও বলতে দ্বিধা নেই যে এই কাহিনীতে ঘটনার ঘনঘটা আর চরিত্রের প্রাচুর্য আমি আর কোনো উপন্যাসে পড়িনি৷ তাও প্রথম থেকে একদম শেষ পর্যন্ত অদ্ভুৎ মাদকতায় আমি পড়েছি। রাত জেগে পড়েছি, পড়ে ঘুমিয়েছি আবার উঠে পড়েছি। এরকম তিনবার নিয়ে বসতে হয়েছে! আর শেষ দিকে তো প্রবল টান, যেনো ভাঁটার টান। অনেক কথা বললাম, উপন্যাসের নামটা বলা হয়নি, — “অনল অন্তরাল”! সভ্যতা কালক্রমে এগিয়ে এসেছে, কিন্তু সমাজ – সভ্যতার পর্দা ক্রমশ পিছিয়ে গিয়েছে…. অতলস্পর্শী যে সে! সূর্যাস্তের পরে যেমন অন্ধকার নেমে আসে, রাঙা আলোর ওপারের গল্প অজানা! সেরকমই পর্দাপতিত হলেই নেমে আসে আঁধার! অজানা থেকে যায় ওপারের ঘটনাপ্রবাহ! লেখকের কলমে উঠে আসে যবনিকার পেছনে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনা, কালের নিয়মে একদিন যা এগিয়ে নিয়ে এসেছে আমাদের আর নিজেরা রয়ে গিয়েছে পেছনে!
কাল বললে আবার সাল-তারিখ বলতে হয়। তবে এ উপন্যাসের কাহিনী আজ থেকে প্রায় তিনশো বছর আগের এবং এখনও হয়তো প্রবাহমান! পড়তে যখন শুরু করেছিলাম তখন এর বিশালতা বুঝতে পারিনি, কি হতে চলেছে আন্দাজ করতে পারিনি৷
একজন সাড়া ফেলেদেওয়া, মরণাপন্ন লেখকের বহুদিনের গবেষণার উপন্যাস সমাপ্ত করার ডাক পড়ে অমিতজ্যোতি নামের এক নবাগতর কাছে…. শয্যাশায়ী রেবন্ত রায় তাকে সবকিছু হস্তগত করেন! এরপর এই কাঁচা লেখকের উপন্যাস যাত্রা শুরু হয়। উপন্যাসের শুরুয়াত যে সময় দিয়ে সেটা ১৭৩২ সাল! এবার ল্যাপটপে উপন্যাসের গল্প টাইপিং এর মাধ্যমে অমিতজ্যোতির ভাষ্যে চলতে থাকে পুরো গল্প! ক্ষমা করবেন, এর চেয়ে বেশি কিছু বলা অসম্ভব। আসলে গল্পটা একটা বহু দিন আগের এক সম্পর্কের সূত্র খোঁজা! তবে গোটা কাহিনীতে সে কালের কোন দিকটা তুলে ধরেননি লেখক, আমি সেটা ভাবছি! কত রকমের গান হতো, সে সবও উল্লেখ আছে। হরু ঠাকুর এর নাম আছে! বললাম তো কে নেই এখানে…! তার সাথে আছে জটিল থেকে জটিলতর সম্পর্কের বুনোট যা মানে না দেশ কালের বেড়াজাল। সতীদাহ থেকে শুরু করে বিধবা বিবাহ – কি নেই সেখানে? এরকম বাস্তব প্রেক্ষাপটের গল্প! যেদিকেই যাই চেনা চেনা গন্ধ! পারাং নদী? সেও চেনা! শোভাবাজার রাজবাড়ি? সেও চিনি! আসলে ইতিহাস টুকরো টুকরো! তারই বা দোষ কোথায়? যে যার গুছিয়ে নিয়ে বাকি ফেলে রেখে দিয়েছে, সেই তো ইতিহাস, সেই তো হেরিটেজ! নবাব আলিবর্দি থেকে শুরু করে হেস্টিংস – ক্যানিং কে নেই? রবার্ট ক্লাইভ! ডিরোজিও — সব্বাই! নাম নিতে গেলে এ লেখা উপন্যাসের এক তৃতীয়াংশ হয়ে যেতে পারে! নতুন করে অনেক কিছু জেনেছি! কিছুদিন আগে গৌতম ভট্টাচার্যের “বারপুজো” পড়ে বলেছিলাম যে এই বইটাকে কোলকাতার লোকজন আপন করে নেবে, এক্ষেত্রেও তাই! পুরনো কলকাতার আরো একটা দলিল হয়ে থাকবে হয়তো। যেমন জেনেছি ছড়াগুলোর মানে! “গোবিন্দরামের ছড়ি, উমিচাঁদের দাড়ি, নকু ধরের কড়ি, মথুর সেনের বাড়ি!” সেরকমই জেনেছি কিভাবে মেদিনীপুর আলিবর্দি খাঁ এর সাথে জড়িত! জেনেছি নবকৃষ্ণ দেবের রাজা হওয়ার গল্প, জেনেছি বহুবাজার থেকে বউবাজারের গল্প! শোভাবাজার রাজবাড়িতে বলি বন্ধ হওয়ার গল্প!আরও অনেক কিছুই! বলে হয়তো শেষ করা যাবে না। গল্প জেনে গেলেও তথ্য জানতে বইটা আবার পড়া যেতে পারে!
সবচেয়ে ভালো লাগার কারণ, গল্পের স্টাইল! বহুদিন আগে প্রীতম বসুর “পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল” পড়ি, পড়ার পর বুঝতে পারি – সবটাই লেখকের মস্তিষ্কপ্রসূত, শুধু টুকরো টুকরো ইতিহাসটুকু সত্যি। এক্ষেত্রে অমিতজ্যোতির ভাষ্যে যতটা বলা হয়েছে, ততটার কতটা সত্য সে আমি জানি না, তবে ইতিহাসের এতো চরিত্রের ভিড়ে, এতো গল্পের ভিড়েও এক অদ্ভুৎ নেশার ঘোরে চুবিয়ে রাখার ক্ষমতা রাখে “অনল অন্তরাল”! এত সব ঘটনার মাঝে একবারও বিরক্ত লাগেনি! আসলে এভাবে ইতিহাস পড়ার সৌভাগ্য হয়নি৷ আমাদের আনাচে কানাচের গলিপথে যদি এতো অচেনা অজানা গল্প লুকিয়ে থাকে, তার আস্বাদ নিতে কার না ভালো লাগে? অন্তত যেখানে পরীক্ষা দেওয়ার মতো যাতনা থাকে না….!
কতগুলো জিনিসের জন্যে আমি কুর্নিশ জানাবো ঔপন্যাসিককে…. এক, তিনি পুরো বছর আড়াইশোর ঘটনাকে টুকরো টুকরো ইতিহাস দিয়ে দারুন কোলাজ বানিয়েছেন, মাঝে মাঝে নিয়ে এসেছেন আজকের দিনে!
দুই, এমন কাহিনী লিখতে গেলে কতটা অধ্যবসায় প্রয়োজন হয়, তা গল্পের পরতে পরতে যে কোনো পাঠক অনুভব করতে পারবেন!
তিন, গল্প একটা নির্দিষ্ট ক্রোনোলজি কে ফলো করে গেলেও তার দেওয়া তিনটি বংশপুঁজি না দিলে পাঠকের কালঘাম ছুটে যেতো, অবশ্য এই উপন্যাসের পাঠকদেরও কম পরিশ্রম করতে হবে বলে মনে হয় না। এই দিক থেকে পুরোমাত্রাই জড়িয়ে রাখতে সক্ষম…. যে যত বেশি জড়াবে সে তত পিছনে তাকাবে।
চার, শিল্পী অমিতাভ চন্দ্রের অলংকরণ! এমন চমৎকার অলংকরণ বারংবার মনে করিয়ে দেয় পাঠক ভুলে গেলেও! তবে আরও দু তিনখানা তুলির টান থাকলে দারুন লাগতো।
আমাদের চেনা পরিধির মধ্যেও এমন অনেক হয়তো গল্প রয়েছে যা আবহমান কাল ধরেই পর্দার ওপারে…..! অবশ্য এমন পর্দা ফাঁসে অদম্য ইচ্ছে লাগে…. অবশ্য সূত্রও লাগে তার জন্যে….! আবার সে অনলে দগ্ধ হওয়ার ভয় থাকলেও চলে না। “অনল অন্তরাল”, প্রায় তিন শতকের একটা শহরের বিস্মৃত ইতিহাসের জীবন্ত একখণ্ড দলিল হয়ে বেঁচে থাকুক বাঙালির হৃদয়ে….একজন ক্ষুদ্র পাঠক হিসেবে এই কামনা করি! প্রণাম জানাই স্যারকে…. তার অধ্যবসায়কে নতমস্তকে আবারও কুর্নিশ! তবে এবার হয়তো শালধোয়ানিয়ার জন্য অসংখ্য রেবন্ত রায় গজাবে, আর আপনাকে তাগাদা দেবে! যাই হোক্ আপাতত মলাটবন্দী অবস্থায় চাই এই উপন্যাসকে!
তবে এ উপন্যাস পড়তে পড়তে বারবার মনে হয়েছে জনৈক কবির উক্তিটি – ”যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন..!”অবশ্য এরকম মনে হওয়ার কারণ অজানা।
পুনশ্চঃ সাবর্ণ রায়চৌধুরীর কথা বলেছেন। এই মানুষটির সাথে মনে হয় মন্দিরময় পাথরার যোগসূত্র আছে।
সিনেমাটা কেন দেখতে চান? ‘নগরকীর্তন’ এর দুটো টিকিট চাইতেই টিকিট কাউন্টার থেকে ইন্টারভিউসম প্রশ্ন ধেয়ে এলো…. বাংলাসহ সারাভারতে আলোড়ন করা বিশেষ এই সিনেমা দেখতে চাওয়া দুই বন্ধুকে এক বৃদ্ধের এই প্রশ্ন।
বললাম – ‘কৌশিক গাঙ্গুলি আমার প্রিয় পরিচালক…..! একটু ইয়ার্কি মেরেই বললাম, বাকিটা দেখে এসে বলি…! ভদ্রলোক হাসলেন। বললেন শুধুই এই কারণ….?
বললাম — না আসলে ঋদ্ধি কেও ভালো লাগে, সেই ‘ওপেন টি বায়োস্কোপ’ থেকেই ফ্যান! বললেন — ‘কৌশিক গাঙ্গুলি প্রিয় পরিচালক, ঠিক আছে, কিন্তু আমার মনে হয় উনি নিজেকে ঋতুপর্ণর জায়গায় নিয়ে যেতে চাইছেন!’
টিকিট কাটা হলো৷
আসলে একটা পরীক্ষা পড়েছিলো কলকাতায়, দুই বন্ধু মিলে ট্রেনে আসতে আসতেই একটা প্ল্যান মাথাচাড়া দেয়, আর পরীক্ষাকেন্দ্র থেকে ১ কিমি দূরত্বে সিনেমাহলে ‘নগরকীর্তন’ চলছে। সুরজিৎ বললো – ‘এ সুযোগ হাতছাড়া করলে অ্যাচিভমেন্ট বলে কিছু থাকবে…?’ এরকম গোছেরই কিছু। অতএব, চলো, এগিয়ে যাওয়া যাক্। ব্যস্ ‘মিত্রা’ দাঁড়িয়ে আছে!
টিকিট তো কাটলাম, দেড় ঘন্টা বাকি এখনো। এদিক ওদিক ঘুরছি, কিন্তু বৃদ্ধের শেষ কথাটা তখনও মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, সিনেমাটা দেখতেই হবে, অতিশয় আগ্রহকে সঙ্গী করে।
——————————————————————
সিনেমা শুরুর আগে কিছু কথা উঠলো।
এই গল্প সেইসব প্রেমের গল্প, যে গুলো আর পাঁচটা প্রেমের মতো নয়।
ভেসে উঠলো Tributed To…. কে হতে পারে? আরে, নান্ আদার দ্যান ঋতুপর্ণ ঘোষ…!
ছবির নীচে ইটালিক্সে লেখা
“পরজনমে হইও রাধা….”
বুঝতে বাকি রইলো না। সদ্য ‘সমান্তরাল’ দেখেছি৷ কৌশিক গাঙ্গুলিও আগে ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’ বানিয়েছিলেন, মুখ্য অভিনয়ে ছিলেন স্বয়ং ঋতুপর্ণ৷ তবে কৌশিক গাঙ্গুলি সাহসিকতার পরিচয় দিলেন। সত্যিই তো সিনেমাটা কেন দেখতে যাবো?
‘ছোটোদের ছবি’, ‘সিনেমাওয়ালা’, ‘শব্দ’ কেন দেখতে গিয়েছিলাম বা কেন দেখেছি?
কারণ উনি অন্যদের কথা বলেন, অন্যকিছু বলেন, সবাই যেটাকে নিয়ে ভাবেন না, যাদের নিয়ে ভাবেন না, উনি তাদের কথা তুলেই ধরেন। তাই…….! এটা অবশ্য বৃদ্ধকে বলা হয়নি৷
পরিমল-পরি-পুঁটি (ঋদ্ধি সেন) এই গল্প একদিকে চলতে থাকে, আর একদিকে….পুঁটির প্রেম চলতে থাকে, প্রেমিকের ওপর ভরসা করে চলতে থাকে জলে থেকে কুমীরের সাথে লড়াই করার অব্যহতির খোঁজ। শৈশব থেকে মনের মধ্যে পুষতে থাকা নারীত্বটাকে বাঁচিয়ে রাখতে তার আবদার — “শরীরে ভুল আছে মধুদা (ঋত্বিক চক্রবর্তী) , শুধরে নিতে হবে….!”
সমান্তরালভাবে দুটো গল্প বলায় একটুও বোরিং লাগেনি, ততটাই সাবলীল লাগলো শুভজিৎ সিংহের কাঁচি চালালনোটা, অবশ্য আগেও ‘ছায়া ও ছবি’, ‘মাছের ঝোল’, ‘বিসর্জন’, ‘শব্দ কল্প দ্রুম’ এর মতো সিনেমাগুলিতে একই কাজ করেছেন।
বহুদিন আগে স্বপ্নময় চক্রবর্তীর ‘হলদে গোলাপ’ পড়েছিলাম, বেশ লেগেছিলো, সিনেমাটা দেখতে দেখতে বেশ ওটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিলো। যদিও সেখানে গল্প ভিন্ন। তবে সেই উপন্যাসের একজনের উল্লেখ ছিলো বারবার, সিনেমাতে দেখি স্বমহিমায় তিনি উপস্থিত – মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়, পরিচালকের মুন্সীয়ানা চোখে পড়লো, সোমানাথ থেকে মানসী হওয়ার লড়াই – গল্প সবকিছু বলিয়ে নিলেন তার মুখ দিয়ে, শুধু তাই নয়, বলিয়ে নিলেন – শ্রীচৈতন্যদেবের শ্রীকৃষ্ণভাবে মজে যাওয়ার ঘটনাটা তার মুখ দিয়ে বলিয়ে নেওয়ার ফলে সিনেম্যাটিক ভ্যালু বেড়ে যায় বলেই মনে হয়৷
সিনেমার দৃশ্যপট এতো বাস্তব যে চেনা ছকের বাইরে বেরিয়েও এই সিনেমা হওয়া সত্ত্বেও বারবার মনে হচ্ছিলো এটা বোধ হয় খুব সহজ একটা ঘটনা৷ মধুদের পৈতৃক বাড়ি – নবদ্বীপ, যেখানে চিত্রনাট্য পৌঁছানোর পর থেকেই একটা ক্ষীণ উৎকণ্ঠা সঞ্চারিত হতে বাধ্য দর্শকদের মনে, যেটা তীব্র হয়, যখন দোলপূর্ণিমার আসরে মধু বাঁশি বাজায়, আর পুরুষরূপী নারীমনের পুঁটির আসল রূপ আচমকাই প্রকাশিত হয়ে যায়।
এরপরও আরো ঘটনা……! ঘটতেই থাকে….! শেষ আধ ঘন্টা দর্শকদের শিরদাঁড়া সোজা করে দিতে বাধ্য, ভাবাতে বাধ্য। সিটে আরাম করে বসে থাকা ঘুচিয়ে দিতে সফল এই সিনেমা। ওয়াটসআপ-ফেসবুকের মাধ্যমে কিভাবে কোনো ঘটনা ভাইরাল করা যায় তা দেখাতেও ছাড়লেন না। ‘নগরকীর্তন’ নামটা বেশ ব্যঞ্জনধর্মী বলেই মনে হলো, নগর বা সমাজে চলতে থাকা অহরহ ঘটনাপ্রবাহগুলোকেই বলা হচ্ছে এখানে।
ঋদ্ধি সেন কেন জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে, তার সদুত্তর মিলবেই, কস্টিউম-মেক আপের সাথে যেভাবে পরতে পরতে নিজেকে খাপ খাইয়েছেন, অসাধারণ….! (তাই দুটো জাতীয় পুরস্কার কস্টিউম আর মেকআপে, নগরকীর্তনের ঝুলিতেই) সাথে আবার ঋত্বিক থাকলে তো পাশের লোককে ভালো অ্যাক্টিং করতেই হবে….! আর্ট ডিরেকশন প্রশংসনীয়। কীর্তনের সাথে যেভাবে মিশিয়ে দিয়েছেন বাঁশিকে, অনেক দুঃখের মাঝে একটা আনন্দের চোরাস্রোত বয়ে যায় দর্শকের অলিন্দ বেয়ে…..! সৌজন্যে – প্রবুদ্ধ ব্যানার্জি….! ভালো লেগেছে সুজন মুখার্জি ওরফে নীলকে, মধুর বৌদির চরিত্রে বিদিপ্তা চক্রবর্তী যতক্ষণ ছিলেন ফাটিয়ে দিয়েছেন, বিশেষ করে তার শেষ দৃশ্যটা৷
মন ছুঁয়ে যায়, কীর্তনের মাধ্যমে বলা – “তুমি আমারই মতন জ্বলিও…” এই অকপট কথা শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে….! রাধার প্রেমে মজে নিজেকেই রাধারাণী করতে উদ্যত।
সবশেষে বলতেই হয় কৌশিক গাঙ্গুলি আবারও একবার প্রমাণ করে দিলেন নিজেকে। অভিনয়ও করিয়ে নিলেন তাদের দিয়ে। ওনারা আশাবাদী এ সিনেমা দেখার পর মানুষজন তাদের হয়তো এতেটা অবজ্ঞা করবেন না। যাদের একঘর করে রাখে সমাজ, তিনি বারবার তাদের উপস্থাপিত করে গেছেন, বলে গেছেন সমাজকে পাল্টে নিতে ভাবধারা, কয়েকজনের বাঁচার মতো সমাজ কি আমারা গড়তে পারিনা, শ্রেনীশত্রু সৃষ্টি করে নিজেদের নির্বুদ্ধিতার প্রমাণ দেওয়ার কোনো মানেই হয় না…!
হলের টিকিট কাউন্টারের বৃদ্ধ মানুষটির দোষ খুঁজে পেলাম না বিশেষ, কারণ এ সিনেমা সবার জন্য নয়, কৌশিক গাঙ্গুলি বলেইছিলেন, এ সিনেমা রোজগারের জন্য বানানো নয়, এগুলো বানানোর পেছনে কিছু উদ্দেশ্য থাকে। বৃদ্ধ মানুষটি হয়তো বোঝেননি….কবেই বা বুঝবেন।
কবেই বা বুঝবেন মানবী বন্দ্যোপাধ্যায় কেন আছেন এ সিনেমায়, কেন উৎসর্গ করার জায়গায় ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবির নীচে লেখা
কথা ছিলো মকর সংক্রান্তিতে কর্ণগড়, দ্বিচক্রীকে বাহন করে যাওয়া হবে! কথা ছিলো বেলপাহাড়ী ঘুরতে যাওয়া হবে! সঙ্গ এবং সময়ের অভাবে বেলপাহাড়ী সিল্করুট আপাতত বন্ধ! কিন্তু ১৪ ই জানুয়ারির কর্ণগড় ভ্রমণকে একটা কনভারশেসন কল মারফৎ এগিয়ে আনতে হলো! পার্টনার? – সেই বছর দুয়েক আগে যে দুজন জুটেছিল। সৌমেন আর ইমতিয়াজ।
প্রবেশমুখ থেকে…
দণ্ডেশ্বর ও খড়্গেশ্বর জীউ মন্দির, প্রবেশদ্বার থেকে
বাসে করে ভাদুতলা, তারপর বাকিটা কর্ণগড় গামী বা শিরোমণিগামী অটোতে চেপেছিলাম মনে নেই, তবে হালকার ওপর ফেন্সি করে ভিড় ছিলো, প্রথমে কোথায় পা রাখবো, তা নিয়ে বেশ ধন্দে ছিলাম। যাই হোক্, অটো চলতে শুরু করতেই বসার জায়গায় ঠিকঠাক সেঁটে গেলাম।
দু বছর পর মহামায়া মন্দিরে এসে “জুতো স্ট্যান্ড” চোখে পড়লো! বহু বহু স্ট্যান্ড দেখছি, জুতো স্ট্যান্ড, এই প্রথম!কে জানে, হয়তো শেষ বারও। বছর দুয়েক রংটা এমনই কৃত্রিম ছিল কিনা মনে নেই মন্দিরের, তবে প্রথম যখন এসেছিলাম মন্দিরের রংটার মধ্যে একটা প্রাচীন প্রাচীন গন্ধ ছিল। সে যাই হোক্, দুপুরে খেয়ে দেয়ে বেরিয়েছিলাম, কারণ আমাদের সাফসুতরো লক্ষ্যই ছিল ঘোরা আর ছবি তোলা! ওখানে যখন নামছি ইণ্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড টাইম বললো দুটো ১৭। তারপর প্রায় দেড় – দু ঘন্টা জুড়ে দাপাদাপি চললো। ফটো শিকার! মকরে এলে ছবি তোলাটা হয়তো ফিকে হয়ে যেতো কিন্তু সেই মহাপ্রসাদ! সে তো প্রাণ জুড়িয়েদিয়েছিলো, সেটা মিস করলাম, স্বাভাবিক। দু ঘন্টার শেষটা কাটলো ঐ পুকুর পাড়ে, সঙ্গে আগের বারের ট্রিপগুলোর স্মৃতি রোমন্থন! বেশ কেটে গেলো। আসার সময়, অটোচালককে জিগ্গেস করতে জানা গেলো – ‘এতো শুধু মন্দির, যে রাস্তা দিয়ে আমরা আসছি, ঐ রাস্তা দিয়ে মন্দির পেরিয়ে গেলে কর্ণগড় এর বিস্তৃত এলাকা চোখে পড়বে, তবে তেমন কিছুই আর নেই!” সবই অঅন্তঃসারশূন্য। তারপর ঠাহর হলো – হ্যাঁ তো, কর্ণগড়, একটা কেমন যেন সমাসবদ্ধ পদ ঠেকছে! চলো তবে একটু হাতড়ানো শুরু হোক্। শুরু করলাম। ওমনি গুগল ঝপঝপ করে কাঙ্খিত দু’খান লিংক দিয়ে দিলো! পড়ে যা জানলাম, বলার চেষ্টা করছি মাত্র-
Descending….
অস্তগামী সূর্যের সামমে
কর্ণগড়ের ইতিহাস অতি প্রাচীন। ইন্দ্রকেতু নামে এক রাজা এই রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে ইন্দ্রকেতুর ছেলে নরেন্দ্রকেতু মনোহরগড় স্থাপন করে সেখানে বসবাস শুরু করেন। রণবীর সিংহ নামে এক লোধা সর্দারকে রাজ্য শাসনের ভার দেন তিনি। অপুত্রক রণবীর সিংহ অভয়া নামে এক মাঝির ছেলেকে পোষ্যপুত্র করে তাঁর হাতে রাজ্য শাসনের ভার অর্পণ করেন। তারপর বংশপরম্পরায় রাজ্য শাসন চলতে থাকে।
কর্ণগড়ের যাবতীয় আকর্ষণ এই মহামায়া মন্দিরকে কেন্দ্র করে। মন্দিরে মহামায়া ও দণ্ডেশ্বরের বিগ্রহ রয়েছে। উৎকল শিল্পরীতিতে তৈরি মন্দিরটিতে পঞ্চমুণ্ডির আসনও রয়েছে। কর্ণগড়ের নিসর্গও মনোরম। গাছগাছালি, নদী দিয়ে চারদিক ঘেরা। মেদিনীপুর শহর থেকে জায়গাটি খুব বেশি দূরেও নয়। তাই এক সময় এই এলাকাটিকে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলার তোড়জোড় শুরু হয়েছিল। পরিকল্পনা ছিল, রাস্তা তৈরি হবে, হবে পার্ক। এবার গিয়ে অবশ্য কিছু কেমন প্রস্তুতি চোখে পড়লো। রাস্তা সারাইয়ের কাজও চলছে।
রয়েছে বলতে শুধু মহামায়ার মন্দির। সংরক্ষণের অভাবে বাকি সব হারিয়ে গিয়েছে। বহু খুঁজেও দু-চারটে ইটের বেশি কিছু মিলবে না। চুয়াড় বিদ্রোহের স্মৃতি বিজড়িত রানি শিরোমণির গড়ের এখন এমনই দশা। গড় অর্থাৎ দুর্গের আর অস্তিত্ব নেই। ১৭৫৫ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু হয় শেষ অপুত্রক রাজা অজিত সিংহের। তাঁর দুই রানি ছিলেন ভবানী ও শিরোমণি। রানি শিরোমণি ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্থানীয় লোকজনদের এককাট্টা করে বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন। এই জন্য ইংরেজদের কোপে পড়েন রানি। তাঁকে বন্দিও করা হয়। নাড়াজোলের রাজা আনন্দলাল খানের মধ্যস্থতায় চরম সাজা না হলেও তাঁকে আবাসগড়ে গৃহবন্দি করে রাখা হয়।
কর্ণগড় ছাড়াও আরও দুটি গড় ছিল রাজবংশের , আবাসগড় ও জামদারগড়। মেদিনীপুর শহরের উত্তরে বাঁকুড়া যাওয়ার রাস্তায় পড়ে। সেখানেও কিছু নিদর্শন মেলে। কিন্তু সময়ের চোরাস্রোতে হারাতে বসেছে সেইসব ইতিহাসের সূত্র। ১৬৯৩ থেকে ১৭১১ সাল পর্যন্ত এই গড়ে রাজ করেছিলেন রাজা রাম সিংহ। পরে রানী শিরোমনি এবং নাড়াজোলের রাজা মোহনলাল খাঁ এই গড়ের উন্নয়ন করেছিলেন।
মেদিনীপুর শহর থেকে উত্তর দিকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে কর্ন রাজবংশের রাজধানী ছিল, তার প্রমাণ আজও মেলে। প্রধান গড় ছিল কর্ণগড়। মেদিনীপুরের প্রায় ১২ কিলোমিটার উত্তর থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার ব্যস ধরলে বিস্তৃত ছিল । এই গড়ের নিজস্ব চরিত্রটি অদ্ভুত। জঙ্গলমহলের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে জলস্রোত নদীর আকার ধারণ করে যেখান দিয়ে বয়ে যেত সেটি গড়ের অন্দরমহল। নদীটি খুবই ছোট, নাম পারাং। গড়ের দু দিক দিয়ে নদীটি প্রবাহিত হয়ে একসঙ্গে মিলিত হত পারাং নদী। অনেকটাই পরিখার মতো। এই গড়ের মধ্যেই ছিল, কুল দেবতাদের মন্দির অধিদেবতা দণ্ডেশ্বর এবং অধিষ্ঠাত্রী দেবী ভগবতী মহামায়া।
তবে মহামায়ার মন্দিরটি এখনও অটুট রয়েছে যেখানে বসে কবি রামেশ্বর ভট্টাচার্য সাধনা করতেন। প্রচলিত রয়েছে, এখানে বসেই রামেশ্বর শিবায়ন কাব্য রচনা করেছিলেন। রামেশ্বরের কাব্যে কর্ণগড়ের উল্লেখও রয়েছে ‘যশোবন্ত সিংহ/ সর্বগুণযুত/ শ্রীযুত অজিত সিংহের তাত। মেদিনীপুরাধিপতি/ কর্ণগড়ে অবস্থিতি/ ভগবতী যাহার সাক্ষাৎ।’
তবে রাণী শিরোমণি স্মরণে মেদিনীপুর শহরেই গেস্ট হাউস আছে, এমনকি ভারতীয় রেল রাণী শিরোমনির স্মৃতির উদ্দেশ্যে আদ্রা-হাওড়া প্যাসেঞ্জার ট্রেনও চালু করেছে! গেস্ট হাউসের কথা কেউ মনে রাখতে না পারলে এই ট্রেনটির কথা তো অনেকেই জানেন!
ভ্রমণপিপাসুদের জন্য কর্ণগড় একদিনের ট্রিপ হিসেবে দারুণ! যতবার যাই, অনেক অনেক ছবি কুড়িয়ে আনি আর মনটা বেশ ভালো হয়ে যায়, উৎসবের সময় না গেলে ওখানের নিরিবিলি প্রকৃতির শোভা বেমালুম উপলব্ধি করা যায়, আর মকরে গেলে তো পায়েসসহ উত্তম প্রসাদ খাওয়ার সুযোগ রইলই!
ঘরের মধ্যে ঘরফ্রেম-এ-ক্যামেরা
পথনির্দেশিকা::মেদিনীপুর/খড়গপুর থেকে বাঁকুড়া রোড ধরে ভাদুতলা, তারপর আর বলতে লাগবে কি! অটোওয়ালারা উপস্থিত মহামায়ার অধিষ্ঠানে হাজির করানোর জন্য।
আসছি সে কথায়। সেদিন একটা পরীক্ষা ছিলো ব্যারাকপুরে, শ্রীরামপুরের ফেরী ঘাট থেকে ফেরী ধরেই জাস্ট নদী পেরোলেই ব্যারাকপুরে আমার গন্তব্য মানে পরীক্ষার সেন্টার! ব্যারাকপুরের ইতিহাস বিজড়িত ধোবিঘাট। মঙ্গল পাণ্ডের ব্যারাকপুর। প্রথম যখন সেন্টার জানতে পারি, সেকি আনন্দ! গুগল ম্যাপে সার্চ করতেই সে জানিয়ে দিলো শ্রীরামপুর রাজবাড়ির গন্ধ পাওয়া যেতে পারে, তারপর ব্যান্ডেল চার্চ, ইমামবারা তো আছেই, আরও কত কি! আমার বাড়ি থেকে এই জায়গা গুলো যদিও খুব দূর নয়, তবুও কখনো যাওয়া হয়ে ওঠেনি, কতবারই তো ইচ্ছে হয়েছিলো। তবে সেদিন সবকিছু ছাড়িয়ে একদম দূরে বাঁশবেড়িয়ার হংসেশ্বরী মন্দির চলে গিয়েছিলাম। বহুদিন থেকে তক্কে তক্কে ছিলাম। বহু লোভ ছিলো সে জায়গা ঘুরে দেখার। প্রথম দর্শনে হ্যারি পর্টারের ক্যাসেল মনে হয়েছিলো, কিম্বা কোনো চার্চ হবে হয়তো। এমন রকমের নির্মাণ শৈলী আগে কখনো চোখে পড়েনি কিনা! শ্রীরামপুর থেকে ব্যান্ডেল তো কাছেই, উদ্যোম ছিলো, দূরের জায়গাতেই আগে যাবো। বাঁশবেড়িয়া তে নেমে একটা টোটো ধরে যখন মন্দির পানে গেলাম, টোটো টা এমন জায়গায় নামালো যে সেখান থেকেই বেমালুম ফটোগ্রাফি করা যায়। মন্দির চত্বরটা এতো সুন্দর প্ল্যানিং করে বানানো যে দারুন ফটোগ্রাফি করা যায়। রাজবাড়ি সংলগ্ন মন্দির। রাজফটক আজ প্রায় ধ্বংসের মুখেই! রাজবাড়ি তে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। দূর থেকেই তাকে নিরীক্ষণ করতে হলো। মন্দির চত্বরে স্ট্রিট লাইট গুলো দেখে মনে হলো সত্যি যেন কোনো ফ্রেঞ্চ বা ব্রিটিশ কলোনিতে পৌঁছে গিয়েছি।
কলোনি যেন…রাজফটকস্ট্রিট লাইটআবছা
আগে কস্মিনকালেও এমন দেখিনি, সাজানো গোছানোও নয়। সবেতেই কিন্তু পুরনো দিনের গন্ধ লেগে আছে। মন্দির প্রবেশের কিঞ্চিৎ পূর্বে একটা জলাশয় পড়ে, বোঝায় যায় রাজবাড়ি আর মন্দির সবই একটা সময়ে পরিখা দ্বারা আবৃত ছিলো, বহিরাক্রমণ থেকে রক্ষার্থে। তবে মন্দিরের সামনে গিয়ে দেখে আমি স্তম্ভিত। ক্যাসেলের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়৷ হংসেশ্বরী এখানে আরাধ্যা দেবী। উপনিষদে হংস মানে জ্ঞান বা আলো। এসব নিয়ে আর কথা বাড়াচ্ছি না৷ প্রথমে নজর কেড়ে নিলো মন্দিরের চূড়াগুলো। পদ্মের নয়নাভিরাম কারুকাজ দৃষ্টি সরাতে দেয় না। মন্দিরের গর্ভগৃহে দেবীর মূর্তি একদমই অন্যরকম৷ শায়িত মহাকালের হৃদপদ্মে মা অধিষ্ঠাত্রী। মূর্তি টি সম্ভবত কাঠের হবে, পরে পড়ে জানলাম দারুমূর্তি অর্থাৎ নিমকাঠের তৈরী। দেবী হংসেশ্বরী যেখানে উপবিষ্টা সে আসনটি অভিনবত্বে ভরপুর, না দেখলে বোঝা মুশকিল।
জগজ্জননী হংসেশ্বরী
অনন্ত বাসুদেব এর মন্দির থেকেপরিখার এপার থেকেরাজবাড়ি এবং মন্দির
যাই হোক্ এই মন্দিরটি ১৪ টি শিব মন্দির দিয়ে চারদিক দিয়ে ঘেরা, মনে হয় যেন এই চতুর্দশ শিব ই দেবীর প্রহরী। মন্দিরটি নির্মাণ কাজ শুরু করেন রাজা নৃসিংহদেব রায়, ১৭৯৯ সালে কিন্তু ১৮০২ সালে তিনি মারা গেলে অসমাপ্ত থেকে যায় নির্মাণ কাজ, তাঁর বিধবা পত্নী রানী শঙ্করী ১৮১৪ সালে নির্মাণ শেষ করেন। ঘুরতে ঘুরতে খিদে পেয়ে গেলো, ভাবলাম খাবোটা কি! দেখি খিচুরি প্রসাদ খাচ্ছে কয়েক জন, ঠাকুর মশাই কে গিয়ে বলতে উনি চল্লিশ টাকার বিনিময়ে একটা পার্সেল করে দিলেন, তাতে খিচুরি, বাঁধাকপির তরকারি, পায়েস, চাটনি আর পাঁপড়….৪০ টাকায় একদম উদরপূর্তি করে প্রসাদ খেলাম, একেই বলে “যে খায় চিনি যোগায় চিন্তামণি….”
অনন্ত বাসুদেব এর মন্দির
এতোক্ষণ অনেকটা সময় মন্দিরকে দিলাম এবার একটু পাশের মন্দিরে আসি… মন্দির সংলগ্ন আর একটি মন্দিরও রয়েছে, এক টুকরো বিষ্ণুপুর যেন। অনন্ত বাসুদেবের মন্দির। মন্দিরটির পাদদেশে প্রতিষ্ঠা ফলক থেকে বুঝলাম ১৬০১, পরে বই পড়ে বুঝলাম সেটা শকাব্দ অর্থাৎ ১৬৭৯ খ্রীস্টাব্দ। রাজা রামেশ্বরদেব রায় মহাশয় এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। কষ্টিপাথরে নির্মিত বাসুদেবের উজ্জ্বল মূর্তিটি এক সময়ে অপহৃত হয়। একটা দারুন তথ্য পেলাম বইটা থেকে, সেটা হলো ভারতবর্ষের বেশ কিছু জমিদার নবাব, বাদশা, সম্রাট ইত্যাদি উপাধি পেলেও একমাত্র বংশবাটী পরিবার বা জমিদাররাই ‘রাজা মহাশয়’ উপাধি পেয়েছিলেন ১৬৭৩ খ্রীস্টাব্দে মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব কর্তৃক সনদ তা-ই বলে। রামেশ্বর দেব ছিলেন তৎকালীন জমিদার।
এক ঝলক টেরাকোটা
মন্দির প্রাঙ্গণটি অসম্ভব সুন্দর। বসে শুয়ে দিব্যি কয়েক ঘন্টা আরামে কাটিয়ে দেওয়া যায়। বেশ ভিড়েও ছিমছাম লাগছিলো কেমন একটা। সব দেখে শুনে এবার, বেরিয়ে আসবো, রাজবাড়ি দেখে লোভ হলো, কিন্তু সে জায়গায় প্রবেশাধিকার নেই, সুতরাং দূর থেকেই……!
রাজার বাড়ি
একটা বোর্ডে মন্দির নিয়ে লেখা আছে, পড়ছি! ১৩ টা চূড়া যে আছে সেটা তখনও খেয়াল হয়নি। ভুল করে ১১ টা গুনে ছিলাম, হাতঘড়ি জানান দিলো ট্রেন এখনো এক ঘন্টা দেরী। সুতরাং, আবার চললাম। এবার হিসেব বললো – নাহহহ ১৩ টাই হবে। হংসেশ্বরী মন্দিরে বিভিন্ন সময়ে পা পড়েছে অসংখ্য গুণীজনের…. রবি ঠাকুর, নন্দলাল বসু, নিয়মিত আসতেন স্বামীজী! রামকৃষ্ণদেব এসেছেন, পদধুলি পড়েছে স্বয়ং ইন্দিরা গান্ধীরও যখন তিনি নন্দলাল বসুর ছাত্রী ছিলেন।
আসলে প্রতিটি রাজ পরিবার এবং তার মন্দিরের সাথে অসংখ্য লোকগাথা, লোকাচার জড়িয়ে রয়েছে, সব কিছু অতি অল্প শব্দবন্ধে ব্যক্ত করা মুশকিল…. আপাতত এইটুকুই হয়তো হংসেশ্বরী মন্দিরে ঘুরতে আসার জন্য প্রেরণা জোগাবে….তবে দারুন ভাবে কয়েক ঘন্টা কেটে যাবে….!
বামদিকে অনন্ত বাসুদেব মন্দির এবং ডানদিকে হংসেশ্বরী মন্দির
পুনশ্চঃ আমি এটা লিখতে গিয়ে একটি বইয়ের সাহায্য নিয়েছি, মন্দিরের পুরোহিত শ্রী তপন চট্টোপাধ্যায়ের ”জগজ্জননী হংসেশ্বরী”…..মন্দির চত্বর থেকেই কিনেছিলাম। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সবই আছে তাতে! তবে এবার নারায়ণ সান্যালের ‘হংসেশ্বরী’ উপন্যাসটা পড়ে ফেলতে হবে, যে বইটা লেখকের কাছে অনুপ্রেরণা ছিলো, নইলে এমন সুন্দর একখানা বই থেকে আমার মতো ভবঘুরে মার্কা লোকজন বঞ্চিত গোবিন্দদাস হয়েই থেকে যেতো…!
পথনির্দেশ – হাওড়া থেকে ট্রেন ধরে বাঁশবেড়িয়া স্টেশন এসে টোটো ধরলেই পৌঁছে দেবে….!
মসনদে আসীন লোকের থেকে ”ঘেউ ঘেউ”, সংবাদপত্রের অসংখ্য শিরোনাম যেখানে শিক্ষককে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়, আবার শিক্ষকদেরও অনেকাংশে ব্যবসায়িক —- সমাজের বিভিন্ন কোওর্ডিনেটে দাঁড়িয়ে ভাবলে যে মুহুর্তে ‘অবক্ষয়’ শব্দটা এসে নাড়িয়ে দিয়ে চলে যায়, সেই রকম একটা ক্ষণে দাঁড়িয়ে “শিক্ষক দিবস” এক অতি আশ্চর্যের দিনই বটে। আসলেই দিনটি ভালোবাসার, উদযাপনের, গল্প বলার, অভিজ্ঞতা বিনিময়ের নাকি নেহাৎই লোক দ্যাখানি তা নিয়ে আমার মধ্যেই দোলচাল আছে। লোক দ্যাখানি তাদের কাছেই যারা দু দিন আগে টেবিল চাপড়ে আজ আবার সেই টেবিলেই শুভেচ্ছা বার্তা সহ উপহার সাজিয়ে দিয়েছে…! আসলে অনুষ্ঠান যতই আড়ম্বরপূর্ণ হোক্ না কেন তা একদম অন্তঃসারশূন্য তো হয় না….! ভালো-খারাপ মিশিয়েই সবটা! ছোটোবেলা থেকে আমরা মা বাবার পরে যা সংস্পর্শে সবচেয়ে বেশি আসি তিনি শিক্ষক! Teacher! Sir, Madam, Mam কোথাও তিনিই দাদা বা দিদি….! আমার আবার সেই সব টিচার কেই বেশি ভালো লাগে বা লাগতো যারা সাবজেক্ট বা পড়াশুনোর গন্ডি ছাড়িয়ে হাজারো যোজন দূরত্ব নিয়ে যেতো আমাদের, আমাকে….! সব সময় পড়াশুনো আবার কি? তবে যত বড়ো হয়েছি ততই পরিশ্রমী, ডেডিকেটেড স্যার ম্যাডামদের ভালো লেগে গিয়েছে, আমার শিক্ষকসুলভ মননটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, আমি আজ গর্ব করে বলতে পারি আমি আমার কাজে ফাঁকিবাজ নই মোটেও তার সবচেয়ে বড়ো কারণ আমার সেই সব স্যার – ম্যাডাম! না, আমি কারো নাম নেবো না, কারণ আমি মনে করি আমার তালিকা অসম্পূর্ণ! আমি বিশ্বাস করি আমার সে সব শিক্ষকরা কিছুই মনে করবেন না তাতে! তারাও জানেন তারা কি অবদান রাখতে পেরেছেন বা পারেননি! একজন স্যারকে পেয়েছিলাম ছাত্র অবস্থার প্রথমের দিকে, ক্লাস সিক্স সেভেন, রিটায়ার্ডের মুখে তিনি তখন, শিখেছি সময়ানুবর্তিতা কাকে বলে! মানে তখন শিখিনি, এখন সময়ে না পৌঁছালে তার হাসিমুখটা মনে পড়ে…! এখনও প্রতিনিয়ত চেষ্টা করি, করে যাচ্ছি সময়ে পৌঁছানোর…. যত বড়ো হচ্ছি, ততই শিখছি নিজের কাছে সৎ থাকার মতো মূল্যবান জিনিস বোধহয় নেই! কজন পারে? একটা স্কুলে পড়াতে গিয়ে ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছিলাম, সোশ্যাল মিডিয়াতে যেই মানুষটাকে দেখে রিটায়ার্ড বুড়ো মানুষরা বলেছেন,’শুভ তুমি বিসিএস’ দাও, সেই মানুষ গুলোকে মুখ ফুটে কিছু বলিনি…! টিউশন পড়িয়ে খাওয়া মানুষটা আমি সারাদিনে বেশি পড়াতেই পারি না, তবে যতটুকু যা করি, ভীষণ এনজয় করি! রোজ কিছু না কিছু শিখছি, প্রবলেম করতে গিয়ে আটকে যাচ্ছি, আবার শিখছি, স্টুডেন্ট রেগে যাচ্ছে, আমিও রেগে যাচ্ছি, আবার শিখছি — অনেক নমনীয় হতে হবে যে…! মহেন্দ্র সিংহ ধোনির ভক্ত আমি, তার একটা হিল্লে তো হওয়া দরকার! সরকারি তকমা লাগানো শিক্ষক হতে পারিনি এখনও….কিন্তু নিজের মধ্যে যে মালমশলা মজুত রয়েছে তার সবটুকু বিলিয়ে দিয়ে যেতে চাই, কিন্তু ভীষণ ভয় হয়! সময়ের সাথে সাথে (সেদিন একজন স্যার বললেন সময় ভেক্টর রাশি, সত্যিই তো না হওয়ার কি আছে? টাইম মেশিন তাহলে?) সর্বশক্তিমান আমার থেকে স্ফূরণ টা কেড়ে নেবেন না তো? এই ভয়টা প্রতিনিয়ত হয়, সময়ের সাথে বয়সের সাথে শিক্ষক মনটা অনেক শান্ত, humble, পজিটিভ হয়ে গিয়েছে….! অনেক সময় ব্যয় করে এগুলো এসেছে, ভয় হয় একদিন হঠাৎ করে যদি ঈশ্বর এসে চেক বই দেখিয়ে উইথড্র করে নেয়? তবে এই সবের মাঝেও পজিটিভ থাকার রসদ জুগিয়ে যায় আমার ছাত্ররা…আমি বিশ্বাস করি আমার ছাত্রছাত্রীরা আমার সবচেয়ে বড়ো শিক্ষক! জীবনের কিঞ্চিৎ ঝঞ্ঝাট, নেতিবাচক প্রভাব সবকিছু কাটিয়ে যাদেরকে পড়ানোর, যাদেরকে তথ্য সরবরাহের তাগিদ, যাদের পরীক্ষা নেওয়ার সদিচ্ছা আমাকে উভমুখী বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে দেয় না — তারাই আসলে আমার শিক্ষক। আমার শিক্ষকরা আমায় যা শেখাতে বাকি রেখেছিলেন তার সবকটায় আমার ছাত্রছাত্রীরা শিখিয়ে দিয়েছে কিন্তু চুপিসারে….! স্টুডেন্টের সাফল্য, অ্যাচিভমেন্ট এর খবর – একজন শিক্ষকের কাছে পরমপ্রাপ্তি। নিজের কাজের প্রতি সৎ থাকার চেষ্টা করি সব সময়….! আমার আয়না তো ওরাই, ওদের ঠকিয়ে আমি কি দেখবো? সত্যি বলতে আমারও মনে হয় শিক্ষক দিবসের মতো আলাদা একটা দিন কেন থাকবে না? সবার তো থাকে একটা করে আলাদা দিন,তাহলে আমাদের জন্য নয় কেন? তবে তথাকথিত শিক্ষক না হয়েও কেমন জানি বিলাসিতা মনে হয় মাঝে মাঝে এদিনটিকে….! না মনে হলেই বোধ করি ভালো হতো। তবে শিক্ষক হিসেবে আমার স্টুডেন্ট রা আমার ছাত্র অবস্থার ভুলের পুনরাবৃত্তি করুক — এটা আমার সহ্য হবে না….! তবে এই মুহুর্তে যা অবস্থা তাতে সত্যি করেই ইচ্ছে করে মুখোশধারী কিছু শিক্ষকের স্বরূপ উদঘাটন হোক্, অবশ্য নোংরা পরিষ্কার এর প্রথম ধাপই হলো আগে জঞ্জালে নামতে হবে আমাকেই…..!
জীবনে শেখার জন্যে শুধু যে শিক্ষিত মানুষই লাগে এমন নয় কিন্তু…. রাস্তাঘাটে, হাটেবাজারে আমরা এমন কিছু ঘটনার সাক্ষী হয়ে যায় তাতে কিছু অপাংতেয় মানুষজনও আমাকে শিখিয়ে যায়। আর শিখিয়ে যায় জীবনের সাথে জুড়ে যাওয়া কেউ কেউ যারা শিখিয়ে দিচ্ছে আবার পরীক্ষাও নিচ্ছে….খুব কঠিনও সে সব…!
প্রথমেই বলে রাখি আমি জীবনে খুব কম সিনেমা দেখার আগে তার ট্রেলার দেখেছি। সব মিলিয়ে হয়তো দশও পেরোবে না। আসলে ট্রেলার দেখলে ঠকে যেতে হয় প্রায়শই। আমার ক্ষেত্রে সে সবের বালাই নেই। ভালো হোক্ বা খারাপ আমি আগে দেখবো৷ যাই হোক্ এটার ক্ষেত্রেও তাই, ট্রেলার দেখিনি৷ কৌশিক গাঙ্গুলির সিনেমা, ট্রেলার – গল্প – অভিনেতা – মিউজিক এসবের কোনো কিছুই আর ডিটেক্টিং ফ্যাক্টর নয় যখন পরিচালক উনি। আমার সবচেয়ে প্রিয় ডিরেক্টর বর্তমান সময়ের যিনি কখনো একদম নিরাশ করেননি। তবে একটু সন্দেহ হয়েছিলো যখন দেখলাম Windows এর প্রযোজনা, ঘটনা হচ্ছে শিবু-নন্দিতার সিনেমা মানেই সেই প্যানপ্যানানি মেলোড্রামা… সে পরিচালক বা প্রযোজক যাই হোক্, আমাকে একদমই টানে না…. এই সিনেমাটার জন্যে একটা অতিরিক্ত কুর্নিশ তাদের তাদের ধারার বাইরের একটা সিনেমার জন্যে অচলায়তনের ‘জানালা’ টা খুলে দেওয়ার জন্যে৷
প্রথমেই কৃতজ্ঞতার পাট চুকিয়ে দিলাম। এবার আসি কেমন লাগলো? গল্প প্রায় সবাই জেনে গিয়েছে। সত্যজিৎ রায়ের ‘দেবী’ র সাথে তুলনা টানা হচ্ছে, অনেকে বলছেন ‘দেবী’ আর ‘গণশত্রু’ র হাইব্রিডাইজেশন। এসব শুনলে কেমিস্ট্রির স্টুডেন্ট হিসেবে বেশ ভালোই লাগে। তবে সেসবের দিকে যাচ্ছি না।
শহর ছাড়িয়ে বহুদূরে এক গ্রামীণ সমাজে তিন বন্ধু, মেডিক্যাল স্টুডেন্ট, রোজকার জীবনযাত্রা থেকে একটু অন্যরকম ভাবনা ভাবে যারা তারা, আর এক সাংবাদিক সকলে মিলে এক অজ পাড়া গাঁয়ে যেখানে সেঞ্চুরি করা হরেন বুড়ো, যে ”দেবতার জন্ম” এর দরুন নিজের জাতকে প্রায় উচ্চবর্গীয় জায়গায় নিয়ে যাওয়ার স্বপ্নে মশগুল। আসলে সে যে স্বপ্নটা দেখেছে এমনটা নয়, বা ইচ্ছে ছিলো এমনটাও নয়, ”দিচ্ছে যখন নে না” এরকম স্টাইলের আর কি! একটা কন্যা সন্তানের জন্ম কি করে সমাজের ফারাক কমিয়ে দিতে পারে, মানে উচ্চবর্ণীয় আর নিম্নবর্নীয় অপাংক্তেয় মানুষজনের মধ্যে পার্থক্য কমিয়ে দিতে পারে, সিনেমার প্রথম ১৫ মিনিট এ নিয়ে চলবে! আর সেটা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করবো আমরা মানে দর্শকরা….! আমরাও জানি আসলেই ভেতরটা ফাঁপা! এই বিশ্বাস যখন জন্মাচ্ছে ঠিক তখনই পরিচালকের মাস্টারস্ট্রোক — রজত রায় সরি রজত নারায়ণ রায় (ইন্দ্রাশিষ) প্রত্যাখান করলেন সে বাড়ির ভোগ খাওয়া! পরিচালক কতটা সুনিপুণভাবে বুনেছেন চিত্রনাট্য আর একটা দৃশ্য বলা যাক্ — যখন হরেন খু্ঁড়োকে বোঝানো হচ্ছে এটা একটা ব্যধি, তার যে শোনা এবং উত্তর দেওয়ার ধরন আর উত্তর — আহা! এটাই তো শুনতে চাইছিলাম! একদিনের জন্যে জাতে উঠেছে একজনের জন্যে, কেন খোয়াবে? হরেন খুঁড়োর চরিত্রটা মনে হয় প্রদীপ ভট্টাচার্যের কথা মনে করেই লেখা হয়েছিলো। এই সিনেমা ভালো লাগার অন্যতম কারণ এটার শুটিং হয়েছে পুরুলিয়ায়, বাঙালি পরিচালকরা গ্রাম বলতে শুধু বোলপুর বা ডুয়ার্সের কোনো গ্রাম বোঝেন, ”বাকিটা ব্যক্তিগত” র পরিচালক প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য বহুদিন আগে এটা নিয়ে বলেছিলেন। কৌশিক গাঙ্গুলি কিন্তু এটা নিয়ে পরীক্ষা করে চলেছেন…টাকি, নবদ্বীপ তারপর পুরুলিয়া,বাকি গুলো আমি জানিনা, তবে আশা রাখি অন্য জায়গাতেই হবে! বহুদিন পরে সিনেমা এলো তার পরিচালনায়, শেষ ছিলো ”নগরকীর্তন”, সেটাও হলে দেখে বেশ গর্বিত হয়েছিলাম এই ভেবে যে আমার পরিচালকের সিনেমা হলে দেখেছি, তাও কোলকাতায়, যদিও সেই মিত্রা সিনেমা হল এখন অতীত, পুরোটাই শুনছি শপিং মল হয়ে গিয়েছে। গোপী ভগতের সমৃদ্ধ ক্যামেরা আর প্রবুদ্ধ ব্যানার্জীর মিউজিক – অসাধারণ বললে কম বলা হবে, “কালো জলে কুচলা তলে” গানটা কে কিভাবে মিশিয়ে দিলেন! সত্যি বলতে গান গুলো সিনেমাটার সাথে ভীষণ মিশে গিয়েছে, মনে হচ্ছিলো যেন Azeotropic mixture, গান গুলোকে ওড়াতে গেলে দৃশ্য সহ উড়ে যাবে! এরকম ভাবে লোকগানের সুচারু ব্যবহার আমি আগে প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য কেই করতে দেখেছি, সাম্প্রতিক!
একটা সদ্যোজাত কিভাবে সমাজের জাতপাত ভেদকে এক নিমেশে ভেঙে ফেললো, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী র “কলকাতার যিশু” র কথা মনে পড়ছিলো! যদিও কনটেক্সট আলাদা। ইক্যুলিব্রিয়ামে আসছে ব্রাহ্মণ আর শূদ্র! ছোটোবেলা থেকে যে শিক্ষায় স্যার ম্যাডামরা বড়ো করেছেন আমরা তো একটা আধুনিক ভারতেরই স্বপ্ন দেখতাম, তবে এই “আমরা” টা এখন আর নেই! সমাজ অসুস্থ? নাকি তার এলিমেন্ট? এসবের উত্তর খোঁজার মতো সময় নেই আমির-গায়িত্রী-শিবনাথ এর কাছে, সময় নেই সাংবাদিক জয় পাত্র র কাছে…! তারা সলিউশন চায়, তারা জয় করতে চাই! স্ট্র্যাটেজি জানে না, জানার দরকার হয় না! আসলে অনেকে বলছে এবং বলবেও এদের লক্ষ্য কি সেটা বোঝা গেলো না! থাকে না–আমার আশেপাশের এরকম “লক্ষ্মী ছেলে” দেখেছি যারা সলিউশনে ব্যস্ত! তারা মেকানিজমের পরোয়া করে না! ব্যস্ততা আর মানবতা বিমুখ মানুষদের ভিড়ে তারা স্বতন্ত্র, তারা সব সময় জেগে আছে! ডাক্তারি পাঠরত আমির (উজান গাঙ্গুলি) র মুখ দিয়ে পরিচালক যে সব সংলাপ বলিয়েছেন যখন হোটেল রুমে গিয়ে তাদের মধ্যে বাদানুবাদের সময় তাদের ডাক্তারি পড়ার সততা নিয়ে বলবে খুব প্রাসঙ্গিক লাগবে….এসি সিনেমা হলে দর্শকের তখন নাচোস (nachos) খাওয়ায় বিরতি! সত্যি বলতে খুব কোরিলেট করতে ইচ্ছে হচ্ছিলো…আমার এক বন্ধু বলে কিচ্ছু না — যে যার নিজের কাজটা করে গেলেই সমাজটা সুন্দর থাকবে। সত্যিই তাই! নিজের কাজ, নিজের ডিগ্রীর প্রতি কটা শিক্ষিত মানুষের সততা আছে? আস্থাটাও কি আছে? এ প্রশ্ন আমিরদের মুখ দিয়ে তুলে দিলেন পরিচালক। আর চরিত্রের নামকরণ? উফফ…. 👌🏼
পরিচালককে কুর্নিশ প্রতিটা চরিত্রকে মেলে ধরার জন্য জায়গা দিলেন! Kia & Cosmos এ ঋত্বিকা কে দেখেছিলাম৷ গায়িত্রীর চরিত্রে কৌশিক গাঙ্গুলি কি সুন্দর জায়গা করে দিলেন ওকে! আর তার যোগ্য জবাব দিলেন ঋত্বিকাও! যখন কথকের ভূমিকায় ওকে শুনছিলাম, তখনও দারুন লাগছিলো। পূরবের চরিত্রটা কে বেশ চেনা লাগে, প্রতিটা বন্ধুদের গ্রুপে এরকম একজন থাকবেই, যার লেগপুলিং করা হবে সবচেয়ে বেশি, যাকে রাগানো সহজ কিন্তু মনটা একদম “লক্ষ্মী ছেলে” র মতো। সত্যিই কি ‘লক্ষ্মী ছেলে’ আছে সমাজে? উত্তর হচ্ছে অবশ্যই আছে, কিন্তু সাক্ষাৎ এর সৌভাগ্য সবার হয় না, হবেও না। যেমন দেখেছে সাংবাদিক জয় মিত্র, অম্বারিশ কে আমার দারুন লাগে, দারুন মানে দারুন! লোকটা হাসিমুখ থেকে হুট করে এত্ত জলদি সিরিয়াস অ্যাক্টিং করে দেয়! জয় মিত্রকে দেখেও কোথাও যেন মনে হচ্ছিলো পরিচালক ন্যারেটিভ সেট করে দেওয়া সাংবাদিকদের থেকে শত যোজন দূরে! এরকম কিছু সাংবাদিকদের আমিও কিন্তু এক্সপেক্ট করি। বাবুল সুপ্রিয়র চরিত্রটা দরকার ছিলোই, প্রভাবশালী লোকজন যে জালিয়াতি করে ভালো কাজও করতে পারে -তারও একটা নমুনা থাকুক! ডক্টরের ভূমিকায় চূর্ণী – পরিচালক তাকেও জায়গা দিয়েছেন, সত্যিই তো একজন এতোটা পেশাগত জায়গা থেকে বেরিয়ে এমন একটা ঝুঁকি কেন নেবেন? পরিচালক তারও উত্তর দিলেন। সত্যি বলতে কি আমার সিনেমাটায় কিছুই খারাপ লাগেনি! এবার প্রশ্ন হচ্ছে সিনেমাটা কি পারলো? উত্তর হচ্ছে সিনেমা একটা শিল্প, সেটার সমাজে কতটা ইমপ্যাক্ট পড়বে তার নির্ভর করছে দর্শকদের ওপরে…সিনেমাটা তো সত্য ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত, রোগটা নিয়ে বেশ কিছু ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে তথ্য আছে, তথ্যগুলোকে আমি বিচার করে দেখিনি সব সত্যি কিনা! তবে বিশ্বাস রাখি সত্যি হবে। ”লক্ষ্মী ছেলে” আসলেই নিজের কাজের ওপর সততার শিক্ষা দেয়, নিজের ডিগ্রী র ওপর আস্থা রাখতে বলে! লক্ষ্যের চেয়ে সমাধান বড়ো, সেই গল্পই বলে যায়। প্রদীপ ভট্টাচার্য কে নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই। কাজের লোক হোক বা এসব চরিত্রে তার জুড়ি মেলাভার, স্ক্রিনে আসা মানে হাসবো, কিছু একটা বলবে! তবে এই সিনেমার সবচেয়ে বড়ো প্রাপ্তি ইন্দ্রাশিষ রায়। “গানের ওপারে” থেকে লোকটাকে দেখছি, সৃজিতের চতুষ্কোণেও ছিলো বোধ হয়, লোকটা RJ SAYAN, AMIT DAS এদের মতোই ইন্দ্রাশিষ ও কি ছুপা রুস্তম! বাংলা সিনেমা তো খলনায়কও হারাতে বসেছে! ওকে নিয়ে অন্যান্য পরিচালকরা কি আরও সচেতন হবেন? তবে সিনেমাটা ড্রামা জঁরার হলেও মাঝে মাঝেই থ্রিলারে প্রবেশ করে ফেলে! এসি রুমে কোল্ড ড্রিংকস খেতে বাঙালি দর্শক প্রেডিক্ট করে – ফেরত নেবে আদৌ? এই জায়গাটা একদম মনের মতো! তখনই মাথায় এলো বছর চারেক আগে Amazon Prime এ দেখা “Lakhon Mein Ek” এর সিজন টু! মনে হচ্ছিলো All well that ends well এই বাক্যটি কি এবার হজম করতে হবে? নিরাশ করলেন না — অসামান্য সিনেম্যাটিক ভ্যালু দিয়ে শেষ করলেন সেই দ্বন্দ্ব গুলোকে। দর্শকের পিঠ তখন সিট ছাড়িয়ে গিয়েছে! আর শেষ ১৫ মিনিট উজান গাঙ্গুলি যে অভিনয়টা ডেলিভার করলেন, হলফ করে বলতে পারি ঋদ্ধি সেন কিন্তু এবার প্রতিযোগিতায় পড়তে বাধ্য!
এরকম সিনেমা আরও হওয়া উচিৎ যেখানে শুধু শহরকেন্দ্রিক নয়, গ্রামের মানুষদের গল্প বলা যায়, এই সিনেমা প্রচন্ড বাস্তব, শহর – গ্রাম মানুষদের বন্ধন তৈরী করে। কোনো শহুরে শিক্ষিত লোক গ্রামের মানুষকে অশিক্ষিত বলেনি, বরং ভিডিও ক্লিপিংস দেখিয়ে সচেতন করতে চেয়েছে, সমাধান চেয়েছে…! এমনটাই তো হওয়া উচিৎ, শিক্ষা যাদের কাছে আছে তাদেরই তো উচিৎ কতটা সহজ উপায়ে সেটা দিয়ে শহর বা গ্রাম কেন্দ্রিক কুসংস্কার গুলোকে নির্মূল করা, যে আধুনিক ভারতের স্বপ্ন আমাদেরকে স্যাররা দেখাতেন, সেরকম একটা। লক্ষ্মী ছেলেদের মতো আরও সচেতন পড়ুয়ারা উঠে আসুক। আর রজত নারায়ণ রায়ের মতো লোক জেল খেটে এসে আবারও টিকিট পাক —- একদম শেষ লাইনেও জয় মিত্রের কথনে পরিচালক এটাও জানাতে ভোলেননি….!
কুর্নিশ ‘লক্ষ্মী ছেলে’! কুর্নিশ কৌশিক গাঙ্গুলি! বাংলা সিনেমা একটু অক্সিজেন পেলো আপনার হাত ধরে আবারও….একটা সৎ প্রচেষ্টা….
“প্রেম হল সময়ের একটা বিন্দু, যেখানে উপন্যাস শেষ হয় আর জীবন শুরু হয়। জীবন হলো একটা রুবিক্স কিউব, সময় নিজস্ব হিসেবে যার প্রতিটি তলের রং মিলিয়ে দেয়। রং হল মানুষের সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্না৷ আর এই সব কিছুর শেষে ক্যানভাসে লেগে থাকে আকাশের নীল আর মেঘলা সাদা। তার বুকে জেগে থাকে ভরে ওঠা কৃষ্ণচূড়া গাছ….”
নীল আর মেঘলা সাদা পশ্চাৎপটে ভরে ওঠা কৃষ্ণচূড়া গাছ কে দেখেছি, বেশ কয়েকবারই… অসম্ভব রঙিন লাগে, সবকিছুর শেষেও তাই কালির দোয়াতে রঙটা থাকে…. সুবর্ণ বসুর সাথে আগে এই পাঠকের কখনো পরিচয় হয়নি…! অবশ্য আগেও লিখেছেন কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক্ হয়ে ওঠেনি পড়া। শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা‘র ১৪২৭ বঙ্গাব্দের সংস্করণের একদম পেনাল্টিমেট উপন্যাসটি আমি অবশ্য সবার শেষে পড়লাম…! ভালোই করেছি। আসলে আর এখন অন্য কিছু পড়তে ইচ্ছে করছে না।
যেই অংশটুকু দিয়ে শুরু করলাম, সেটা দিয়েই বলি…! আসলে আমাদের সবারই জীবনটা সুখ-দুঃখ সমস্তটা নিয়েই। প্রত্যেকেই একটা সময় “ছায়াপ্রহর” নামের সময়টা কাটাতে হয়…. এই “ছায়াপ্রহর” বিষয়টা কি? “গোধূলির ছায়া পেরিয়ে রাত হয়, উষার ছায়া পেরিয়ে দিন। ছায়াবৃত্ত নির্ঘুম প্রহরীর মতো দিনের সঙ্গে রাতের দেখা হতে দেয় না। অসহায় মানুষ শুধু একটু আলোর তৃষ্ণায় চাতকজন্ম লালন করে চলে তার অবচেতনে। অর্নিদিষ্টকাল….” লেখকের কলমে এতো সহজ সরল ভাবে উঠে এসেছে সে সংজ্ঞা…! আমরা সকলেই একটা সময়ে সেই আলোকবর্তিকার মুখাপেক্ষী…! কবে দেখা দেবে সে আলো?
এরকমই আলো-আঁধারির মাঝেই অসংখ্য গল্প বুনেছেন উপন্যাসিক, যেখানে বিতস্তা নামের এক পাগল নদীসম মেয়ে রোজ রোজ কনফিউসড হয়ে যায় সৌরাশিস নামের এমন একজন প্রেমিকের সাথে সম্পর্ক নিয়ে যে কিনা নিজের জীবন নিয়ে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খল, যেখানে অনুপ্রিয়ার মতো একজন যুবতী রুখে দাঁড়ায় তার দিদি ভানুপ্রিয়ার বিয়েতে এক সৌদাগর শ্বশুরের সামনে…. যে গল্পে সোমদেববাবু আর বিনতীদেবী চান বুড়ো হয়ে স্কাইওয়াক করতে… শেষ পর্যন্ত মায়ার জঞ্জালে আবদ্ধ হয়ে পড়েন নাকি রয়ে যান? যে গল্পে দারুন পড়াশুনো আর রেজাল্ট করেও ঋতদেবের মতো ছেলে হয়ে ওঠেন বিভিন্ন ভেঞ্চারে সফলতম ব্যক্তি যার একটা ভেঞ্চার এখনো মার খায়নি…. টিউশন থেকে শুরু করে খাবারের দোকান… যে গল্পে শুকদেব এর দারুন কেরিয়ার হার মেনে যায় ঋতদেবের কাছে কিন্তু শুকদেব সেই দাদা হয়ে ওঠে যে ভাই এর ভেঞ্চারকে কুর্নিশ জানায়, যে গল্পে সুমনার মতো নারী চরিত্র প্রোটোটাইপ বিবাহিত মহিলার গল্পের ওপর ভর করে সংসার করে যদিও পরে ভুল বুঝে যায়! এই গল্পেই আবার এমন একজনের সাথে দেখা হয় যিনি আবার বইপাগলা নামে খ্যাত – বন্ধুব্রত ভট্টাচার্য, যার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে বই দেখাবে আলো… গভীর রাতের পরে যে উষার আলো দেখা যাবে তাতে আলোকবর্তিকার কাজ করবে বই… তার দাবী – “বইয়ের নেশা ধরাতে হবে মানুষকে। মানুষের হাতে-হাতে ঘুরবে বই, একজন পড়ে আর-একজনকে দেবে, সে আবার তারপরের জনকে।” অবশ্য আজকাল সেরকম আর কোথায় হচ্ছে? এই নিয়ে বন্ধুবাবুর অবশ্য আক্ষেপ বা স্বগোতক্তির শেষ নেই। “বইকে ভাইরাল করে দিতে হবে। আজকাল ভাইরাল বলে মানুষের হাতে-হাতে যা ঘোরে সেগুলো সব ক্ষণিকের বুদ্বুদ। কিছু থাকবে না।”
লেখককে অশেষ ধন্যবাদ জানাতে হয় বর্তমান বাংলায় স্কুল সার্ভিস কমিশনের বৃহত্তর আয়োজন নিয়ে কথা বলার জন্য… শুধু তাই নয়! তার থেকে বেরিয়ে আসার সমূহ সম্ভাবনা তিনি দেখিয়েছেন ঋতদেব আর অধিরাজ এর জুটি কে দিয়ে… হয়তো অদূর ভবিষ্যতে এই ঋতদেবরাই হবেন শিক্ষিত একদল বাঙালির ভেঞ্চার আইকন…! অনুপ্রিয়া চরিত্রটি যথেষ্ট যুগোপযোগী! শতাক্ষীর মতো চরিত্রও বেশ পরিচিত আমাদের…. খুবই কাছের মানুষ তারা কিংবা ভানুপ্রিয়ার সাথে বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর সুজয় প্রসাদের মতো চরিত্র অবশ্য বিরল কিন্তু সেসব মানুষের স্বরূপ উদঘাটন করতেও তো সামনাসামনি যেতে হয় যা করেছে অনুপ্রিয়ার মতো মেয়ে…!
তবে পড়তে পড়তে পাঠকের বেশ আনন্দই লাগবে শেষে, শুরুতেই যেমন অনেক রকম ভাঙন দিয়ে শুরু হয়েছিলো…. পড়তে পড়তে মনে হয়েছে এই তো সব মিলিয়ে দিলেন…. কিন্তু ঐ যে “ছায়াপ্রহর”…. গল্পের নায়িকা যে ছায়াকে বলছে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকতে… কিন্তু কেন? আসলে উপন্যাস শেষ না হওয়া অবধি একফোঁটা আন্দাজ করা মুশকিল…. সেই যেন মাটির পাত্রে জল রেখে কিছুক্ষণ পরে ফেলে দিলেও যেমন জলের দাগটা রয়ে যায়…. সেরকমই….! গল্পে শুধু সমস্যাই নেই, আছে সেখান থেকে উত্তরণের পথের হদিশ! আর এখানেই সার্থকতা! “মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয় আড়ালে তার সূর্য হাসে…. ” লেখক সেই আলোও দেখালেন।
এ কাহিনী পড়তে পড়তে অনেকবারই নিজেকে খুঁজে পেয়েছি… আমি নিশ্চিত শুধু আমি নই… প্রত্যেকটা পাঠক উপন্যাসের গলিপথ দিয়ে যাওয়ার সময় কোথাও না কোথাও নিজেকে খুঁজে পাবেন… স্পষ্ট বা অস্পষ্ট অবয়বে ধরা দেবে তার প্রতিমূর্তি! নীরবে….
পুনশ্চঃ লেখাটা যে আমার জন্যে কতটা দরকার ছিলো সেটা হয়তো সময় বলবে…. লেখককে কুর্নিশ! দীপঙ্কর ভৌমিক মহাশয়ের অলংকরণ গুলিও নজরকাড়া – স্বীকার করতেই হয়…! লেখককে আরও একবার কৃতজ্ঞতা জানাই বন্ধু বাবুর মত চরিত্র সৃষ্টির জন্য….
১৯৩৫ সাল… অ্যাডিলেডে একটি হকি ম্যাচ চলছে… দর্শক আসনে স্বয়ং ডন ব্র্যাডম্যান, একজনের খেলা দেখে উচ্ছ্বসিত! বললেন – “He scores goals like runs in cricket…”
যাকে নিয়ে বলছেন তিনি মেজর ধ্যানচাঁদ! অবশ্য নামটা আসলেই ধ্যান সিং ছিলো। মাত্র ১৬ বছর বয়সে যখন Indian Army তে যোগ দিলেন, তখন প্রখর দৃষ্টিশক্তি আর রিফ্লেক্সের জন্য চাঁদের আলোয় প্র্যাক্টিস শুরু করলেন। মজা করে সতীর্থরা নাম দিলেন ”চাঁদ”, সেই থেকেই ধ্যান চাঁদ, নামের পরের “সিংহ” উবে গেলো। কিন্তু তার খেলা থেকে উড়লো না….! ছোটো থেকেই ধ্যানজ্ঞান ছিলো হকি স্টিকটা! পেয়ে গেলেন একটা রেজিমেন্টও, তখন চুটিয়ে হকি খেলা হতো সেখানে, হতো প্রতিযোগীতাও৷ কিভাবে সুযোগকে কাজে লাগাতে হয় সেটা ধ্যানচাঁদ শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। প্রথমে সুযোগ পেলেন ঘরোয়া টুর্নামেন্টে, ব্যস্, নজর পড়লো জাতীয় নির্বাচকদের৷ চললেন কিউইদের দেশে, দুই ডজন থেকে মাত্র চারটে গোল কম করে সেই যে দ্বৈরথ শুরু হলো…. বাকিটা ইতিহাস৷ দেশে ফেরামত্রই আগে পেলেন Lance Nayak এর পদ।
খবরে…
আমস্টারডাম, অলিম্পিক – ১৯২৮ বেশ কিছু মাস আগে একটা খেলায় ইংল্যান্ড কে হারিয়ে দেওয়ায় ব্রিটিশরা কুটনীতি করে আমস্টারডামে ভারতীয় হকি দলকে পাঠালেন না, বেশ টালবাহানার পরে অবশ্য সেটা হয়। অবশ্য ১৯২৪ এর প্যারিস অলিম্পিকে পরিকাঠামোর অভাবে হকি রাখা না হলেও ১৯০৮ আর ১৯২০ এই দুবারই সোনার পদকটা পেয়েছিলো ব্রিটেনই! সুতরাং তাদের একটা ভয় ছিলোই। ভারতীয় দল প্র্যাক্টিস ম্যাচ থেকেই নজর কাড়তে শুরু করে। প্রথম ম্যাচ অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে ৬-০ তে জয়। তারপর একে একে বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড এবং ফাইনালে ডাচরা! জয়ী ভারত! ধ্যানচাঁদ গোটা টুর্নামেন্টে করলেন ১৪ টা গোল। স্থানীয় সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হলো – “This is not a game of hockey, but magic. Dhyan Chand is, in fact, the magician of hockey.” এটাই অলিম্পিকে ভারতের প্রথম সোনা জয় এবং কোনো গোল হজম না করেই!
আমস্টারডামে প্রথমবার সোনার ছেলেরা
১৯৩২, লস অ্যাঞ্জেলস
প্রথম ম্যাচে জাপানকে ১১-১, ফাইনালে আমেরিকাকে ২৪-১…. এতো গোলের ফুলঝুরি বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলো। সহোদর Roop Singh কে সঙ্গে নিয়ে দুই জনে মিলে গোল করলেন ২৫ টা। ক্রীড়াজগৎ আখ্যা দিলো Hockey Twins. দ্বিতীয় সোনা ভারতের সেই হকির হাত ধরেই।
Dhayn Roop Singh – the Hockey Twins
এরপর অধিনায়কের দায়িত্ব পান। ১৯৩৩ সালে ভারতীয় হকির অন্যতম সম্মানজনক Beighton Cup এ Jhansi Heroes কে জেতান, পরেও অনেকবার বলেছেন সে ম্যাচটাই তার জীবনের প্রিয় ম্যাচ ছিলো, Calcutta Customs এর বিরুদ্ধে। তিনি বলতেন – “If anybody asked me which was the best match that I played in, I will unhesitatingly say that it was the 1933 Beighton Cup final between Calcutta Customs and Jhansi Heroes. Calcutta Customs was a great side those days; they had Shaukat Ali, Asad Ali, Claude Deefholts, Seaman, Mohsin, and many others who were then in the first flight of Indian hockey.”
The Golen Era of Indian Sports
১৯৩৬ অলিম্পিক, আসর এবার বার্লিন, হিটলারের দেশে
বিভিন্ন দেশকে ৪০ টা গোল দিয়ে, একটিও হজম না করে ধ্যানচাঁদের ভারত ফাইনালে। গোটা বার্লিন শহর ভারতীয় দলের সাফল্য নিয়ে মজে গেলো। পোস্টারে ছয়লাপ সে শহরে – “Visit the hockey stadium to watch the Indian magician Dhyan Chand in action.” গোটা য়ুরোপের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দর্শক উপস্থিত…। বলা হতে লাগলো – “The Olympic Complex now has a magic show too”. ফাইনালে প্রতিপক্ষ – জার্মানি যারা ভারতকে প্র্যাকটিস ম্যাচে ৪-১ গোলে হারিয়েছিলো, একটু চিন্তিত ছিলো ভারতীয় শিবির। দলের ম্যানেজার পঙ্কজ গুপ্তা তখনকার দিনের একটা পতাকা আনলেন, যেটা জাতীয় কংগ্রেস ব্যবহার করতো, ত্রিরঞ্জিত! তেতে উঠলেন খেলোয়াড়রা! শুরু হলো খেলা! স্টেডিয়ামে অ্যাডলফ হিটলার! প্রথমার্ধে জার্মান গোলকিপারের সঙ্গে জোর সংঘর্ষে দাঁত খোয়ালেন ধ্যানচাঁদ, কিন্তু দমে যাননি! সতীর্থদের বললেন – ওদের উচিৎশিক্ষা দিতে হবে, কিভাবে বল কন্ট্রোল করতে হয় ওদের শিখিয়ে দেবো৷ প্রথমার্ধে একটু আটকে রাখতে পারলেও, দ্বিতীয়ার্ধে শুরু হলো সেই ধুন্ধুমার খেলা, নিজেদের অর্ধ থেকে বলের নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করলো জার্মানরা…. নাস্তানাবুদ করে ছাড়লো The Wizard এবং কোম্পানি! ৮-১ গোলে জয় এলো, ফাইনাল জেতার হ্যাটট্রিক করে পরপর তৃতীয় বারের জন্য সোনা পেলো ভারত। উল্লেখযোগ্য অবদান দুইভাই ধ্যানচাঁদ সিং আর রুপ সিং এর।
The Wizardহিটলারের দেশে সোনাজয়ী দল
এরপরেই সেই বিখ্যাত কথোপকথন, যা আজও ধ্যানচাঁদ কে নিয়ে কথা হলে বলতেই হয়। হিটলার এবং ম্যাজিশিয়ানের মধ্যে–
That conversationbetween Dhyan Chand & Hitler
হিটলারের প্রস্তাবের সামনেও শিরদাঁড়া সোজা রেখে কথা বলেছেন তিনি৷ আবার বেশ মজার হলেও কোনো খেলায় গোল না করতে পারলে অভিযোগ জানাতেন গোলপোস্ট এর মাপ নিয়ে এবং দেখা যেতো যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তেমন ভুলটাই হয়েছে। ১৯২৬ থেকে ১৯৪৮ এর বর্ণময় কেরিয়ারে প্রায় ৪০০ র বেশি গোল করেছেন তিনি৷ তাঁর সম্মানার্থে দিল্লীর জাতীয় হকি স্টেডিয়ামের নাম ২০০২ সালে পরিবর্তন করে করা হয়েছে Dhyan Chand National Hockey Stadium, দেশের বাইরেও এরকম নামকরণ হয়েছে৷ লন্ডনে একটি টিউব স্টেশন আছে তাঁর নামে, জিমখানা ক্লাবেও তিনি উজ্জ্বল অক্ষরে বিরাজমান। হকির জাদুকর বা ম্যাজিশিয়ানের জন্মদিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে তাই প্রতি বছর এই দিনটিকে ভারতবর্ষে জাতীয় ক্রীড়া দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয়, দেশের প্রতিটি কোণা থেকে বিভিন্ন ক্রীড়াক্ষেত্রের ব্যক্তিত্বদের পুরস্কার প্রদান করা হয় তাদের সাফল্য এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের নাম গৌরবান্বিত করার জন্যে….
ধ্যান চাঁদ স্টেডিয়ামরেজিমেন্টে…
১৯৫৬ সালে ভারতীয় আর্মি ছাড়ছেন যখন তখন তিনি ‘মেজর’…. আজ যখন ভারতীয় টিম অলিম্পিকে জায়গা পেতে হিমশিম খেয়ে যায়, তখন আমরা তাঁকে আমাদের দিবাস্বপ্নে অনুভব করতে চাই, করে ফেলি হয়তো…. তিনি শুধু সোনাই দেননি, এটাও বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছেন যে – হকি খেলেও বিশ্বে নাম কুড়ানো যায়। Happy Birthday, the Wizard!
সাল ১৯৭১ দক্ষিন আফ্রিকার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জন ভর্স্টার এবং অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট বোর্ডের চেয়ারম্যানের বাদানুবাদ! বিষয়? — ক্রিকেটে জাতিবিদ্বেষ এবং দক্ষিণ আফ্রিকা দল জড়িয়ে পড়ছে তাতে। কৃষ্ণাঙ্গদের জাতীয় দলে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না – এই নিয়ে সে দেশ তোলপাড়! ভর্স্টার এর মতে তাদের যোগ্যতা নেই। অষ্ট্রেলিয়া ক্রিকেট বোর্ডের তরফ থেকে চেয়ারম্যান জানিয়ে দিলেন – “We will not play them until they choose a team on a non-racist basis.” তিনি জন কে রীতিমতো ভর্ৎসনা করে জানিয়ে দিলেন — তিনি আদৌ ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের বা গ্যারি সোবার্সের নাম শুনেছেন?
Cut to সাল ১৯৮৬ স্থান – পলসমুর জেলখানা…. তৎকালীন অষ্ট্রেলিয় প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম ফ্র্যাসের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে, সে দেশের জেলবন্দী সংগ্রামী নেলসন ম্যাণ্ডেলার সাক্ষাৎপ্রার্থী তিনি… তাকে দেখা মাত্রই ‘মাদিবা’ র প্রশ্ন – “Mr Fraser, can you tell me, is Donald Bradman still alive?”
স্যার ডোনাল্ড জর্জ ব্র্যাডম্যান! আজ ২৭ শে আগষ্ট, আজ তাঁর জন্মদিন, ১৯৭১ এর সেই ক্রিকেট প্রশাসক যিনি ক্রিকেটে জাতিবিদ্বেষের প্রবেশ করতে দেননি। পরিসংখ্যানের আতিশয্যে ডুবে থাকা ব্র্যাডম্যান যে শুধুমাত্র সেরা ক্রিকেটার ছিলেন, তাই নয়, দারুন মানুষও ছিলেন। প্রাক্তন অজি ক্রিকেটার ট্রেভর বেইলির কথায় উঠে আসে সেই কথায় – “He was perfectionist, good at everything he did and very nice man as well”, অবশ্য ম্যাণ্ডেলা আর ডনের কখনো সাক্ষাৎ হয়নি৷ মাদিবা জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ব্র্যাডম্যান তাকে একটা ব্যাট উপহার দিয়ে পাঠান, তাতে লেখা ছিলো – ‘To Nelson Mandela, in recognition of a great unfinished innings’ এরকমই অনেক গল্প আছে ডনকে নিয়ে, তেমনই কিছু পরিসংখ্যান গল্পের মোড়কে শোনা যাক্
ডন ব্র্যাডম্যান এবং তার প্রিয় সাথী
🏏 ৮০ টা ইনিংসে (১০ টা নট আউট) ৬৯৯৬ রান, গড় – ৯৯.৯৪, বলা হয় শেষ ইনিংসে শূন্যের বদলে তিনি যদি চার রান করেও আউট হতেন, তাহলেও তার সর্বকালীন গড় একদম তিনের ঘরে পৌঁছে যেতো। চার্লস ডেভিস নামক এক বিজ্ঞানী তার গবেষণায় দাবী করেন ডনের গড় ১০০ হওয়াই উচিৎ। স্কোরিংয়ের ভুলে ১৯২৮-২৯ অ্যাসেজ সিরিজের টেস্টে তাঁর একটা বাউন্ডারি নাকি জ্যাক রাইডারকে দিয়ে দেওয়া হয়। ওই বাউন্ডারিটা পেলে টেস্ট গড় ১০০ই দাঁড়ায়।
Sachin and Warne met Don on his 90th Birthday
🏏 এক ব্র্যাডম্যান পাগল গবেষক অনেক বছর রিসার্চের পর বলেন যে ডনের পূর্বসূরিরা ইতালীর লোক। পরে জানা যায় তার দাদু জাহাজি ছিলেন, উদ্দেশ্য ছিলো ডাচেদের দেশ কিন্তু পথ ভুলে চলে আসেন সিডনি। এই ভুলটা না হলে হয় তো এমন কিংবদন্তিকে পাওয়া যেতো না যাকে নিয়ে সে দেশের ক্রিকেটার বিল উডফুল বলেছেন – ‘ডন তিনজন অজির সমান’।
🏏 ১৯৪৮ সাল। ভারতে এক আঞ্চলিক দলের সাথে ক্রিকেট খেলছিলো মহারাষ্ট্রের দল, নিম্বলকর নামে এক ব্যাটসম্যান যখন ৪৪৩ রানে অপরাজিত তখন দুই দল এবং আম্পায়ার মিলে সেই ম্যাচটি আর না খেলার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ? ডন ব্র্যাডম্যানে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রান ৪৫২, তাই তাদের মনে হয়েছিলো এটা করাই বোধহয় সম্মান জানানো যাবে। একই ঘটনা ঘটেছিলো একটি আন্তর্জাতিক ম্যাচে, অধিনায়ক মার্ক টেলর ব্যাট করছিলেন ৩৩৪ রানে, অপরাজিত। ব্যাট না করার সিদ্ধান্ত নেন। তার মনে হয়েছিলো – ‘স্যার’ কে টপকানোটা ঠিক হবে না৷ কারন – ডন ব্র্যাডম্যানের টেস্ট কেরিয়ার এর সর্বোচ্চ স্কোর ৩৩৪…
সেই প্র্যাক্টিস
🏏 ডন এর শৈশব কেটেছে বাউরালে, সিডনি থেকে বেশ দূরে! তার জীবনের প্রথম শতরান তিনি এখানেরই একটা স্কুলে পড়ার সময় করেন ১২ বছর বসয়ে স্কুল ক্রিকেটে। এইখানের শেফার্ড স্ট্রিটে তাঁর বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দান করেছিলেন স্বয়ং শচীনও। বলা হয়, এখানেই একটা পুরোনো জলট্যাঙ্কিতে একটা স্ট্যাম্প দিয়ে আর গলফ বল দিয়ে প্র্যাকটিস করতেন, যা তার রিফ্লেক্সে সাহায্য করেছিলো।
Bradmanesque
🏏 ব্র্যাডম্যান প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটে একই দিনে ২০০ বা তার বেশি রান করেছেন — এমন ঘটনা ২৭ বার ঘটেছে। সুতরাং, বলা যায় তিনি বোলারদের ওপর বেশ কর্তৃত্ব বজায় রেখেই খেলতেন। পরবর্তী কালে Collins English Dictionary তে ডনের এই ডমিনেটিং দৃষ্টিভঙ্গির সম্মানে “Bradmanesque” শব্দটি কে ঠাঁই দেওয়া হয়, যার অর্থ হলো বিপক্ষ দলের বোলারকে ডমিনেট করা।
🏏 প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট নিয়ে কথা উঠলে বলতে হয় — এই লোকটি ১০০টার বেশি শতরান করেছিলেন এবং সেটা ২৯৫ ইনিংসে, তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ইংল্যাণ্ডের ডেনিস কম্পটন করতে নিয়েছিলেন মাত্র ৫৫২ টি ইনিংস!
🏏 ডনের সময়কালেই তাঁর তীব্র কম্পিটিটর ছিলেন ‘ওয়ালি’ হ্যামন্ড! গড়ের দিক থেকে তো তাইই। কিন্তু মজার কথা হলো ডন সারাজীবনে টেস্ট কেরিয়ারে কুড়ি ওভার বল করে দুটিই উইকেট পেয়েছিলেন এবং তার মধ্যে একজন ইংল্যান্ডের হ্যামন্ড৷ যদিও প্রথম শিকার ক্যারিবিয়ান ইভান ব্যারো।
🏏 ডনের অধরা রেকর্ডের মধ্যে একটা ৯৭৪ রান, পাঁচ ম্যাচের টেস্টে, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে । যেটার কাছে গিয়েছিলেন একমাত্র ওয়ালি, ৯০৫ রান। তাছাড়াও টেস্ট সিরিজের সেরা গড় – ২০১.৫, দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে, এটাও অধরা!
🏏 হ্যারাল্ড লারউড, ডগলাস জার্ডিন খ্যাত ১৯৩২-৩৩ এর বিখ্যাত বডিলাইন সিরিজের প্রথম টেস্ট থেকে ডন ব্র্যাডম্যানের সরে যাওয়া নিয়ে ইংল্যান্ড শিবিরে দারুণ হাসাহাসি চলতো। ডন ব্র্যাডম্যান অবশ্য মুখরক্ষা করেছিলেন – ৫ ম্যাচের এই অ্যাশেজ সিরিজে ব্যাটিং গড় ছিলো ৫৬.৫৭! জ্যাক ফিঙ্গলটন নামের এক অজি ব্যাটসম্যান বলেছিলেন – এই সিরিজ ব্র্যাডম্যানের স্টাইলে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে। বস্তুত এই সিরিজেই ডন জীবনে প্রথম এবং শেষবারের জন্য প্রথম বলে শূন্যরানে আউট হন! পরে লারউডকে এই সিরিজ নিয়ে জিগ্যেস করা হলে তিনি বলেন – “Bodyline was devised to stifle Bradman’s batting genius. They said I was a killer with the ball, without talking into account that Bradman, with the bat, was the greatest killer of all.”
সামরিক বাহিনীতে
🏏ব্র্যাডম্যান তার কেরিয়ার চলাকালীন দেশের মোট টেস্ট রানে ২৬ শতাংশই কন্ট্রিবিউট করেছিলেন। ১৯৪০ থেকে ১৯৪৬ এই ছ বছর তার ক্রিকেট জীবন স্তব্ধ ছিলো কারণ তিনি ১৯৪০ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে সে দেশের সামরিক বাহিনীর সাথে, আবার Air Force এও ছিলেন।
Such an Australian Cricketer
🏏 ভারতীয় ক্রিকেট দলের বিরুদ্ধে ছয় ইনিংসে তাঁর গড় ১৭৮.৭৫, এই সিরিজেই একমাত্র ভারতীয় হিসেবে বিজয় হাজারে তাকে শিকার করেছিলেন। ১৯৪৭-৪৮ এর এই সিরিজের একটা আলাদা গুরুত্ব অবশ্য আছে। প্র্যাকটিস ম্যাচের পর বিল ব্রাউনকে ভিনু মানকড় একটি টেস্টে আবারও সেই বিতর্কিত ”মাকড়ীয়” রান আউট করেন। ধারাভাষ্যকার এবং সংবাদপত্রে ভারতীয়দের স্পিরিট নিয়ে প্রশ্ন ওঠে…! পরে ব্র্যাডম্যান তাঁর আত্মজীবনী “Farewell to Cricket” এ লেখেন – “For the life of me, I can’t understand why (the press) questioned his sportsmanship. The laws of cricket make it quite clear that the non-striker must keep within his ground until the ball has been delivered. If not, why is the provision there which enables the bowler to run him out? By backing up too far or too early, the non-striker is very obviously gaining an unfair advantage.” এটাই স্যার ডন ব্র্যাডম্যান।
🏏 নামের আগে ‘স্যার’ কেন? কারণ তিনি ‘নাইটহুড’ সম্মানে ভূষিত এবং এখনও পর্যন্ত এই উপাধিতে ভূষিত একমাত্র অস্ট্রেলিয় তিনি৷
🏏 নার্ভাস নাইন্টিন নিয়ে আমরা কত কথা বলি। তিনি কখনো ৯০ এর ঘরে গিয়ে আউট হননি৷ আন্তর্জাতিক কেরিয়ারে অন্তত তাই-ই।
🏏 অস্ট্রেলিয়ার সমস্ত প্রদেশ এবং প্রদেশের রাজধানীতে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটবোর্ডের যে অফিস আছে সব অফিসের পোস্টঅফিস নাম্বার ৯৯৯৪। এটি স্যার ডনের ব্যাটিং অ্যাভারেজ ৯৯.৯৪ এর সম্মানে।
PO – 9994
🏏 আন্তর্জাতিক কেরিয়ারে মোট ছটা ছয় মেরেছিলেন, তার মধ্যে একটা ভারতের বিরুদ্ধে আর বাকিগুলো ইংল্যান্ড এর বিপক্ষে। মজার কথা হলো সারাজীবনে তার বাউন্ডারি আর ওভার বাউন্ডারির পাশে দুটো পাঁচ রানও আছে।
🏏 ১৯৭৮ এর দিকে, ডনের অ্যাডিলেডের বাড়িতে আড্ডাতে এককালের বিশ্বত্রাস জেফ থমসন। রসিকতা করে একজন বলেন আজকের ডনকে কি থামাতে পারবেন থমসন! তৎক্ষনাৎ চ্যালেঞ্জ লুফে নেন দুইজনই! তবে নিরাশ হতে হয়েছিলো জেফকেই। মানে খেলা ছাড়ার তিরিশ বছর পরেও এমন রিফ্লেক্স দেখে তাজ্জব বলে গেছিলেন জেফ, যিনি সবে আট বা ন বছর রিটায়ানমেন্ট নিয়েছেন।
পিয়ানোবাদক
🏏 স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যান এর ক্রিকেট শিল্প নিয়ে তো বিস্তর কথা হয়। কিন্তু তিনি আর্টিস্ট ছিলেন যথেষ্টই! ২০১৮ তে আইসিসি একটি প্রতিবেদন বের করে – A Band Of Cricketers, তাতে দেখা যায় মিউজিকের প্রতি তার আগ্রহ। 1930 সালে ”Everyday is a rainbow day for me” বলে একটা গানের রেকর্ড পাওয়া যায়, পিয়ানোবাদক হিসেবেও তার রেকর্ড আছে, ‘Old fashioned locket’ এবং ‘Our bungalow of dreams’ এবল দুটিই ১৯৩০ ইংল্যান্ড সফরে, কলম্বিয়া রেকর্ড স্টুডিও তে করা সেসব। এইসব জিনিসপত্র অবশ্য অনেকদিন চাপা পড়েছিলো, ডোনাল্ড এর নাতনি এগুলো উদঘাটন করে।
🏏 শুধু তাই নয়৷ ১৯৩৬ সালে National Production Ltd.এর সাথে তার চুক্তি হয় এবং সে চুক্তি অনুযায়ী – কোনো সিনেমায় ক্রিকেট খেলার দৃশ্যে তাকে অভিনয় করতে হবে, মানে প্রধানত তার খেলার দৃশ্য দেখানো হবে৷ এই মর্মে একটাই মাত্র পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবিতে দেখা যায় — “The flying Doctor”, সেখানে দিনের শেষে নায়ক (যিনি দর্শক) একজন খেলোয়াড়ের সাথে হাতাহাতিতে জড়িয়ে জেলখানার পথ দেখবেন। এই সিনেমার একটি দৃশ্যে ডন ব্র্যাডম্যানকে খালি গায়ে দেখার সৌভাগ্য হয় দর্শকদের।
ফিল্মে ব্র্যাডম্যান
🏏 রাস্তাঘাট তো নামকরণ করা হয়ই। কিন্তু ব্র্যাডম্যানকে শ্রদ্ধা জানাতে সেদেশের একটা ”বোয়েয়িং” এয়ারক্রাফট কে স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যানের নামে নামাঙ্কিত করা হয়েছে। শুধু তাই নয় গন্ধে ও বর্ণে অতুলনীয় Meilland International SA Breed নামের এক গোলাপ ফুল এর নাম Sir Don Bradman Rose রাখা হয়েছে।
এটিই সেই বিখ্যাত গোলাপ ফুল
🏏 তিন ইনিংসে ৫০ গড় শুরু, তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি, সবসময়ই ৫০ এর বেশি গড় থাকা কিংবদন্তীর স্কুল জীবনে প্রিয় বিষয় ছিলো গণিত।
🏏 তার শৈশবে বাড়ি যেটা বাউরালের শেফিল্ড স্ট্রিটে, সেখানে সম্প্রতি একটি ক্রিকেট মিউজিয়াম খোলাও হয়েছে। একটি মূর্তিও আছে এখানে, মেলবোর্ন আর অ্যাডিলেডেও মূর্তি আছে এই কিংবদন্তীর৷
বাউরাল, শেফিল্ড স্ট্রিটে বাড়ি – এখন মিউজিয়াম
🏏 ডনকে নিয়ে অনেকে প্রশস্তি বাক্য শোনা গেলেও, আমার কাছে ওয়ালি হ্যামন্ড এর উক্তিটি সেরা, তখন ওয়ালি ক্যাপ্টেন — “I was forced to admire the cool way Don batted. On one or two occasions, when he was well set, and when he saw me move a fieldsman, he would raise his gloved hand to me in mock salute, and then hit the next ball exactly over the place from which the man had just been moved. Reluctantly I had to admit once more that he was out of the ordinary run of batsmen – a genius!”
জিম লিকার এর ভাষ্যে…
🏏 তবে এতো প্রশংসার পরেও স্বদেশীয় বোলার রডনি হগ বলেছেন যে ব্র্যাডম্যান এই যুগে খেললে হয়তো সেরা গড়ে পৌঁছাতে পারতেন না৷ রেডিওতে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন – “Sir Donald Bradman was a freak, but I don’t think he would have averaged 99 now.”
ক্রিকেটার, নির্বাচক এবং ক্রিকেট প্রশাসক প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি ‘ডন’ ছিলেন, স্বীকার করে নিতেই হবে৷ নিজের খেলার স্টাইল নিয়ে জিগ্যেস করলে বলতেন – “Predominately a back foot player” কিন্তু ৯২ বছরের জীবনে কখনো তাকে ফিরে তাকাতে হয়নি।
বাংলা সিনেমা জগতের এরকম আরও অনেক সংলাপ দিয়ে তিনি অমরত্ব লাভ করেছেন….! আজ তাঁরই জন্মের শতবর্ষ! ২৬ শে আগষ্ট, ১৯২০ খৃষ্টাব্দে তিনি বাংলাদেশের (তখন সবটাই ব্রিটিশ ইণ্ডিয়া) মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন মোক্তার আর মা সুনীতাদেবী শিক্ষা দপ্তরের চাকরি করতেন! সরোজিনী নাইডুর আত্মীয়া তিনি আবার! অবশ্য এমন হাসাতে পারেন যিনি তার জন্ম যে পূর্ববঙ্গে হবে এমনটাই তো স্বাভাবিক, যদিও বাপ মা প্রদত্ত নাম ছিলো সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায়। “সাম্যময়” থেকে “ভানু” হয়ে ওঠার গল্পটা এতো সহজ নয় অবশ্য! হতে পারতেন অভিনেতা বাদে অন্যকিছু – স্বদেশী বা বিপ্লবী বা হয়তো পার্টির সর্বময় কর্তা কিন্তু হলেন কি? ‘কমেডিয়ান’ ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। বলতেন — ছিলাম ‘বাঁড়ুজ্জে’, হয়ে গেলাম ‘ভাঁড়ুজ্জে’…! অবশ্য শুরুটা এভাবে হয়নি। খুব ছোটবেলা থেকেই গুরু মানতেন বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত কে। ছোটবেলা থেকেই তার সাইকেলে চেপে ঘুরেছেন বিস্তর। শুধু তাই নয়, বুকের মধ্যে নিষিদ্ধ বই চেপে বা টিফিন বক্সে রিভলবার নিয়ে ঘুরেছেন, পাচার করেছেন। দীনেশ গুপ্ত মারা যাবার পর জড়িয়ে গিয়েছিলেন অনুশীলন সমিতির কাজে। তখন ঢাকার জগন্নাথ কলেজে, বিজ্ঞানী সত্যেন বসু, রমেশচন্দ্র মজুমদার বা কবি জসীমউদ্দিনের প্রিয় ছাত্র তিনি, এদিকে পুরোমাত্রায় জড়িয়ে পড়েছেন স্বদেশী আন্দোলনে, হুলিয়া জারি হল তার নামে, ছাড়তে বাধ্য হলেন বাংলা, তাও আবার এক বন্ধুর গাড়ির ব্যাকসিটের পাদানিতে শুয়ে! ভাবা যায় এ পার বাংলায় আগমণটাও তার এরকম নাটকীয়ভাবে হয়েছিলো। এরকম স্বদেশী করা লোক কর্মজীবনের প্রথম দিকে অভিনয় করে বেড়ালেন বেশ কিছু নাটকে, অতঃপর পরিচালকদের নজরে পড়েন। প্রথম ছবি অবশ্য ‘জাগরণ’, ১৯৪৭ সালে, পরিচালক বিভূতি চক্রবর্তীর ডাকে স্টুডিওতে গিয়ে হাজির। পরিচালক বলে বসলেন দুর্ভিক্ষপীড়িত চিমসে চেহারা চরিত্রে তাকে অভিনয় করতে হবে৷ জানতে চাইলেন ভানু রাজি কিনা! ভানু ‘হ্যাঁ’ করতে দেরী করেননি। আসলে তখন ভানু বেশ রোগা ছিলেন, সেটা আমরা ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ দেখলেই বুঝতে পারি। সাড়ে চুয়াত্তরেই ভানু প্রথম সাড়া ফেলে দেন, তার কারণ এক ঝাঁক নতুন অভিনেতা – অভিনেত্রীর কেরিয়ার শুরু হতে চলেছে একই ছায়াছবি দিয়ে কিন্তু ভানুর দিশি স্টাইলের কথাবার্তা তাকে আলাদা করে চিনতে বাধ্য করেছিলো। “মাসিমা মালপো খামু” – সংলাপটি তাই আজও প্রতিটা বাঙালির মুখে মুখে। রোগা চেহারার ভানু সেই প্রথম এক ঝাঁক জাত শিল্পীর মাঝেও নিজের স্বতন্ত্রতা তুলে ধরতে পেরেছিলেন, এই ছবি যদি ভালো করে দেখে থাকেন, তাহলে বুঝবেন যে একজন শিল্পী প্রতিটা আলাদা সিচুয়েশন মোতাবেক কেমন হাসাতে পারেন, এদিক থেকে তার মতো সিচুয়েশনাল কমেডিয়ান অভিনেতা বাঙালি আর দেখেনি! শুধু অভিনয় করে হাসাতেন না, বরং আজকাল ওগুলো দেখলে যেনো মনে হয় উনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন – এটাই কমেডি অ্যাক্টিং, আর পার্থক্য বুঝিয়ে দিয়েছেন ওনার হাসানো আর কাতুকুতু দিয়ে হাসানোর মধ্যে। “সাড়ে চুয়াত্তর” এ মেসের মিটিং এ কেদারের উপস্থিতি, আমার মতো মেসে থাকা পাবলিকদের কাছে আদর্শ হয়ে থাকবে বোধ হয়। এর পর বেশ কিছু ছবি করলেও, কয়েকটি ছবি আজ অমরত্ব লাভ করেছে, যেমন – ”যমালয়ে জীবন্ত মানুষ”, ”৮০তে আসিও না”, “ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট”, “ভানু পেলো লটারি”, ”পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট”, “মিস প্রিয়ংবদা”…. এর মধ্যে কিছু কিছু ছবিতে ভানুই হিরো আবার টাকাও উনিই ঢেলেছেন। কিন্তু কতগুলো কমেডি, কতগুলো রোমান্টিক কমেডি, আবার বেশ কয়েকটি ছবিতে ভানু-জহরের যুগলবন্দী আমরা দেখতে পাই।
কেদার এর চরিত্রে ভিড়ের মাঝে
“যমালয়ে জীবন্ত মানুষ” নিয়ে কথা বলতে গেলে শেষ হবে না….. স্বর্গলোকে যমালয়ে ভুল করে তুলে এনে যে কি বিপদ করেছে সেখানের কর্মীরা…!একজন জীবন্ত মানুষ ধরে ধরে ভুল ধরছেন যমরাজ থেকে চিত্রগুপ্তের…। সিস্টেম বদলাতে বদ্ধপরিকর তিনি। সহাস্যে বলছেন ‘যতদিন আছি বুঝলে বিচিত্রগুপ্ত, অপঘাতে মৃত্যু নিয়ে একটা বিহিত করে যাই…’। বিপ্লবী অনন্ত সিংহ ছিলেন ছবির প্রযোজক — তার প্রথম দুটো সিনেমা ফ্লপ করলে, ভানু তাকে বরাভয় দেন। বাকিটা আমরা দেখতে পেয়েছি, আমার তো মনে হয় সিনেমাটা যতটা রোম্যান্টিক কমেডি তার চেয়ে বেশি স্যাটায়ার! স্বর্গলোকের প্রতিটা চরিত্রের সাথে তার কথোপকথনগুলো আলাদা আলাদা ভিডিও ফাইল করে রাখতে ইচ্ছে করে…. তিনি বলছেন – “সেবাই তো আমার ধর্ম, তার ওপর আমি আবার মানুষ!” একবারও ঐ চরিত্রে ভানু ছাড়া ইহ জগতের আর কাউকেই কল্পনা করা কষ্টের ব্যাপার। সিনেমাটি অবশ্য একটি হলিউড ফিল্ম থেকে অনুপ্রাণিত কিন্তু কে ওসব মনে রেখেছে। আবার এই সিনেমাতেই ভানুকে আমরা পেয়েছি দারুন রোম্যান্টিক হিরো হিসেবে…. মাধুরী – সিদ্ধেশ্বর এর প্রেমের দৃশ্যগুলো যেমন রোম্যান্টিক, তেমনই কমেডির। তার প্রেমিকা প্রেম করতে গিয়ে ভক্তিমূলক গান গাইছে, সেখানে পাশে বসে ভানুর মুখের অভিব্যক্তি গান শোনা থেকে বিরত রাখতে বাধ্য। আবার ভানু-জহরের ঐ অপঘাতে মৃত্যু নিয়ে যে দৃশ্যটা ওটাও অসামান্য….ডুবলো কিন্তু মরলো না, অথচ সাঁতারও জানে না। উর্বশীকে নাচ শেখানোর দৃশ্য — ‘হাম হাম গুড়ি গুড়ি’ নাচ! এই সিনেমাটা দেখার পর ঐ ছোটোবেলাতেই যে এই নামটা নিয়ে কতবার হেসেছি, গুনে শেষ করা যাবে না, এমনকি এখনও! সেখানে নাচের নাম জিগ্যেস করতেই সিধুর অকপট স্বীকারোক্তি – “আগ্রহই হচ্ছে নাচের প্রধান অঙ্গ”, “নাচের একটা ভালো নাম থাকলে আর নাচতেই হয় না…”! এই জায়গাটাই চোখ ফেরানো যায় কি? যায় না।
সিধু হয়ে যমালয়ে
এরপর কথা বলতে গেলে “৮০ তে আসিও না” নিয়ে বলতে হয়, সেখানে আবার সমাজের এক অন্য রূপ, ব্যঙ্গের মাধ্যমে। এক বৃদ্ধের যুবকে পরিণত হয়ে যাওয়ার গল্প, আসলে গল্পটা কিন্তু অন্য – একজন বৃদ্ধের প্রতি তার ছেলেমেয়েদের অবহেলার গল্প। এই সিনেমাতেও ভানু আর রুমা গুহ ঠাকুরতার রসায়ন দেখার মত। “আমি এখন জল পুলিশের আন্ডারে” — এই সংলাপটিকে ভানু ছাড়া অন্য কেউ অমরত্ব দিতে পারতেন কি? মনে হয় না পারতেন বলে। আবার এ ছবিতে জহরও আছেন।
জল পুলিশের Under এ
“পার্সোনাল অ্যাসিসট্যান্ট” আরও একটা ছবি যেটা ভানুর নিজের ছবি, একদমই নিজের, রমাপদ গুপ্ত থেকে রমা গুপ্ত আর মিনতি মিত্র হওয়ার গল্প কোন্ ভানুপ্রিয় দর্শকের মনে নেই! ঐ ছবিতে মেদিনী দেবীর বাড়িতে পিয়ানো বাজানোর দৃশ্য আজও পেটে খিল ধরাতে বাধ্য, তরুন কুমার আর ভানুর বন্ধুত্বের যে সমীকরণ ছবিতে দেখতে পাই, সেটা দারুন লাগে। টাইপিং টেস্টের সময় ভানুর ভেকগুলো তীব্র হাসির উদ্রেক করে আট থেকে আশি – সবারই। এই ছবিটা অবশ্যি করার কথা ছিলো উত্তমকুমারের, কিন্তু মনমতো স্ক্রিপট না পাওয়ার কারণে তিনি সরে দাঁড়ালে ভানুর কাছে অফার আসে, লুফে নেন ভানু৷ নচিকেতা ঘোষ গান লিখে ফেলেছেন উত্তমকুমার আছে জেনে…. ভানু স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন শুনে তিনি বলেছিলেন – যা ব্বাবা, ভানু থাকবে জানলে আমি গানই লিখতাম না। অবশ্য সিনেমা দেখে প্রশংসাই করেছিলেন। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে গল্পের অভাব নেই। তার বাড়িতে বসতো চাঁদের হাট। কে আসতো না? উত্তমকুমার থেকে সুচিত্রা সেন, সুপ্রিয়া দেবী থেকে অনুপ কুমার, সোমিত্র চট্টোপাধ্যায়। বিকাশ রায়কে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন, উনি বাড়ি এলে নাকি ওনার পাশে বসতেন না, বসতেন পায়ের কাছে। ছবি বিশ্বাসও ছিলেন ভানুর ভীষন কাছের মানুষ, দিন দুবেলা ভেনোর বাড়ি আসা চাই-ই চাই। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবিতে ছবি বিশ্বাস আর তুলসী চক্রবর্তীকে নেওয়া একরকম বাধ্যতামূলকই ছিলো।
রমাপদ থেকে রমা হয়ে মিনতি মিত্র
তারপর ‘ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিট্যান্ট’ সিনেমাতেও সেই জুটি। বাংলা চলচ্চিত্রের জগতে কমেডি সিনেমা বললে এটা আসবেই….! আমি জানি না এরকম আসল নামেই অভিনেতার ভাগ্যে চরিত্র জুটেছে ক’জনের কপালে! ঐ ফিল্মে ‘কমলা’ তদন্ত উদঘাটনে আসা বৃদ্ধার সাথে ভানু – জহরের দৃশ্যটা দেখবার মতো। ভানুর মুখভঙ্গি আলাদা মাত্রা দেবে যখন বলবে “দুধ!, দুধ দেয়?” বা ”আমরা গোরুর কেস করি না”….. এগুলো সবই চলন্ত ফ্রেম হয়ে থাকবে!
আসল নামেই চরিত্র – অভিনয়
‘ভানু পেলো লটারি’ র প্রথমেই জহরের আগমণ আর ঐ ‘জহুরে’ বলে ডাক্ বলেই দেয় অফস্ক্রিনে তাদের বন্ধুত্বের গাঢ়ত্ব কতটা ছিলো। তখন খুব ছোটোবেলা, টিভিতে দিতো সিনেমাটা৷ ‘আমার এই ছোট্ট ঝুড়ি’ গানটাতে ভানুকে দেখার জন্যে মুখিয়ে থাকতাম, এই ছবিতে ভানুর গোঁফটাই ছবির ডিএনএ। সাথে, জহরের পাশে একফ্রেমে বাঙালির হৃদয়ে চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে। তারপর দুই ভানু সামনে আসার পর তো আরোই হাস্যকর।
ভানু তখন মধ্যগগণে…
ভানুর আরও একটি হিট ছবি “মিস প্রিয়ংবদা”, হাসির দৃশ্যের জন্য আগের ছবিগুলোর সাথেই যেটাকে স্মরণ করা হয়। বামা চরিত্রে তিনি যে বহুমুখী একটা অভিনয় করেছিলেন, সেটা দেখলেই মনে হয় কত বড় মাপের অভিনেতা ছিলেন…. তরুন কুমারের সাথে গলায় কাঁথা গলিয়ে ধূমপানের দৃশ্যটি বেশ হাস্যকর! মানে উনি যে চরিত্রটা করতেন, তাতে বাঁচতেন, আগের সবগুলোকে সেই মুহুর্তে ভুলিয়ে রাখতে পারতেন। সেরকমই একটা দৃশ্যে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন যেখানে প্রিয়ংবদা নামের মহিলা সেজে তিনি হরিধন বাবুর কাছে যাবেন তাকে পটাতে! এ দৃশ্য দেখার পর ঐ সিনেমার আগের হাসির দৃশ্য কিছুই আর মনে থাকে না।
তরুন – ভানু জুটিতেও
অনস্ক্রিনের ভানুর সেন্স অব হিউমর নিয়ে কথা বলি আমরা কিন্তু মানুষটার পর্দার বাইরের রসবোধ নিয়েও অগাধ কাহিনী আছে। ইষ্টবেঙ্গলের ভক্ত ছিলেন, শচীন দেব বর্মনের সাথে খেলা দেখতে গিয়ে তার থেকে ঝেঁপে খেয়েও নিতেন। ম্যান ম্যানেজার ছিলেন দারুন। শ্যুটিং এ তাকে দেখতে ভিড়! সামাল দিলেন ভানু! ঢাকার হস্টেলে পুজোর খাওয়া নিয়ে গোলমাল….. ভানু এলেন এগিয়ে, উচ্চকণ্ঠে ঘোষনা – কাউকে খাওয়ার দরকার নেই। রসিকতা করতেন গলা ছেড়ে…. প্রায়শই আড্ডাতে বলতেন – ‘‘আমার দশা ক্যামনে শুনেন। মা মারা গ্যাছে। শ্মশানে গেছি। চোখে জল। একটা লোক কাছে আইয়া কইল, আরে ভানুদা কী হইসে? কোনওক্রমে কইলাম, ভাই মা মারা গ্যাসেন। শুইন্যা হাসতে হাসতে চইল্যা যাইতে যাইতে কইল, ‘দ্যাখ, ভানুরে কাঁদলে কেমন লাগে!’ বুঝেন একবার! হালা, নিজে যখন শ্মশান যামু লোকে দেইখ্যা বলবে, ওই দ্যাখ, ভানুর মাথাটা কেমন নড়তাসে!’’ এইসবই তাঁর ভাগ্যবান পুত্র গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষ্যে পড়ি আনন্দবাজারে। কোলকাতা তার এতোটাই প্রিয় ছিলো যে মুম্বইয়ের ডাক প্রত্যাখান করেছেন সহজেই। গুরু দত্তের ‘পিয়াসা’ র অফার ছেড়েছিলেন। তবে বন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে ‘বন্দীস’, ‘মুসাফির’ সিনেমাতে অভিনয় করেছিলেন। আসলে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন আদ্যোপান্তো দেশীয় সংস্কৃতির মানুষ, চার্লি চ্যাপলিনের স্টাইলটাকে পুরোমাত্রায় দেশীয় স্টাইলে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। বিকাশ রায়, ছবি বিশ্বাস এরা ছিলেন ওনার দাদার মতো, গুরু মানতেন…আর জহর? লোকজন ভাবতো এদের খুব কম্পিটিশন কিন্তু একটা ঘটনা সে সব তোয়াক্কায় করতে দিলো না — ভানু গাড়ি কিনেছে, স্টুডিও তে জহর সবাইকে ডেকে বলে দিলো — ভেনোই একমাত্র যে বাংলাদেশে কৌতুক অভিনয় করে গাড়ি কিনেছে। এটা ওর একার গাড়ি নয়, ভেনো প্রতি শনিবার আমার জন্য গাড়ি পাঠাস….. শারদীয়া এই সময় এ এটা পড়েছিলাম। আর ভানু সত্যিই তেল ভরে গাড়ি পাঠিয়ে দিতেন, নিজে ব্যস্ত থাকতেন, ট্যাক্সি তে চড়তেন আর জহুরে চষে বেড়াতো শহর। ভাবা যায়! আমরা শুধু রুপোলি পর্দায় দেখেই আহ্লাদিত হয়ে যায়!
পার্শ্বচরিত্র হলেও সমানে নজর কেড়েছেন
সেই কত ছোটোবেলায় দেখেছিলাম ‘ভ্রান্তিবিলাস’, এখনও মনে আছে তার “কিংকর” চরিত্রটাকে.. ঐ নিশিতে ডাকার সিনে তার যে অভিব্যক্তি এখনও চোখে লেগে আছে। “চৌরঙ্গী”র শাজাহান হোটেলের সবাইকে ভুলে গেলেও ভুলতে পারবো না ন্যাটাহরি কে! ঐ কোঁকড়ানো চুল আর গোল চশমার ছবি দেখলে যে কেউ বলবে ওটা নিত্যহরির অবয়ব। এগুলো সবই ভানুর পার্শ্বচরিত্র কিন্তু তাতেও দাগ রেখেছেন সমানে। ‘পাশের বাড়ি’ বলে একটা ছবি করেছিলেন কেরিয়ারের প্রথম দিকে, বেশ কিছু বছর পরে হিন্দিতে ‘পাড়োসান’ হচ্ছে, মেহবুব তো ভানুর কাছে চলে এলেন পরামর্শ নিতে, একই রোল যে। সাড়ে চুয়াত্তর এর কাজ দেখে কেষ্ট মুখুজ্জে প্রায় কোলে তুলে নিয়েছিলেন।
তবে ভানুর বেশ কিছু ছবির রেকর্ড আজ আর পাওয়া যায় না। বেশ কিছু বছর আগে ‘নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে’ ছবিটির সংস্করণ উদ্ধার করা হয়, নইলে বাংলা সিনেমার দর্শক ভানুর অভিনীত সেরা সিনেমাটা দেখা থেকে বঞ্চিত হতেনই। সারা জীবন কমেডি চরিত্রেই অভিনয় করিয়ে যাওয়া পরিচালকরা বোধ হয় বুঝতে পারেননি যে উনি সিরিয়াস চরিত্রেও সমান দক্ষ এবং এই ছবি তার প্রমাণ। প্রহ্লাদ চন্দ্র ঘোষ থেকে পরাশর ঘোষ থেকে সন্ন্যাসী – চরিত্রটা ভানু অসামান্য শিল্পনৈপুণ্যতায় তুলে ধরেছেন। এই সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন ওনার নিজের মেয়ে, বাসবী বন্দ্যোপাধ্যায়, শিশু শিল্পীর চরিত্রে! এই ছবিটা দেখার পরে হয়তো অনেক দক্ষ পরিচালকই হাত কামড়ে ছিলেন ভানুর জাত সঠিকভাবে না চিনতে পারার জন্য। এই ছবির কিছু গানের তালিম হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে নিতে হয়েছিলো ভানুর স্ত্রীর কাছে, যিনি আবার নামকরা গায়িকা ছিলেন, আকাশবাণীতে গাইতেন। এই ছবির প্রথমার্ধ হাসালেও দ্বিতীয়ার্ধ যে কোনো মানুষকে কাঁদিয়ে দেবে এবং তার একমাত্র কারণ ভানুর অভিনয়।
নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়া ভানু
ভানু, উত্তমকুমার থেকে শুরু করে জহর, অনিল চট্টোপাধ্যায় এনারা ‘অভিনেতৃ সংঘ’ করেছিলেন, কিন্তু একসময় উত্তমকুমার সেখান থেকে বেরিয়ে গেলে ভানু আঘাত পান, কাজ কম পেতে থাকেন। কিন্তু কখনোই বসে থাকেননি। রেডিও তে নাটক করলেন, হাস্যকৌতুক করলেন! তার কিছু কিছু নমুনা আজ আমরা ইউটিউবে পায়। বেশিরভাগটাই হয়তো আমরা সংরক্ষণ করতেই পারিনি। বেশ কয়েকবার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পরে মারা যান ১৯৮৩ তে! মারা যাওয়ার পরের বছর তার শেষ অভিনীত সিনেমাটি মুক্তি পায় – শোরগোল। শুধু আক্ষেপ একটাই শুধুমাত্র কমেডিয়ান হয়েই রয়ে গেলেন। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় এমনই একজন শিল্পী যিনি প্রতিটি চরিত্রে বেঁচেছেন, উত্তরসূরীকে শিখিয়ে গিয়েছেন কমেডি অ্যাক্টিং আসলেই কি, যিনি আদ্যোপান্ত বুঝিয়ে দিয়েছেন – দেশীয় সংস্কৃতিটাকে নিজের মধ্যে দিয়ে জনমানসে বাঁচিয়ে রাখার মাহাত্ম্যটাও শিল্প, যিনি বরাভয় জুগিয়েছেন পরিচালকদের মনে অথচ কত সহজ সরল এবং স্বতন্ত্র ভঙ্গিমায় নিজের হিট ছবিগুলো পর পর দিয়ে গেছেন….. জন্মশতবর্ষে এসেও তাই তিনি প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে বেঁচে আছেন…..আসলেই তিনি “জীবন্ত মানুষ” !
ব্যক্তিগত জীবনে ‘ভানু’
সাহায্য — ১. শারদীয়া এই সময় (১৪২৬) ২. আনন্দবাজার পত্রিকার ” পত্রিকা” সংস্করণ
সত্যজিৎ রায়। হ্যাঁ, ছোটোবেলা থেকে এই একটা পরিচালকের নাম আমাদের সবার চেনা। কত বড়ো মাপের পরিচালক ছিলেন। ধরুন, তারই বাড়িতে একদিন হুট করে চলে গেলেন আনকোরা কোনো অভিনেতা যিনি হয়তো আগে একটি সিনেমাতেই অভিনয় করেছেন। হ্যাঁ, ঠিক এমনটাই করেছিলেন কামু মুখোপাধ্যায়। ওনার যে সাহসের ওপর ভর করে সত্যজিৎ রায়ও স্বস্তির ঘুম দিতেন, মানুষটি এরকমই ছিলেন। হঠাৎ করেই একদিন ‘মাণিকদা’র বৈঠকখানায় গিয়ে বলে বসলেন —‘আমি আপনার ছবিতে অভিনয় করতে চাই’। আক্কেলটা ভাবুন খালি। সত্যজিৎ রায় ফিরিয়ে দেননি। “চারুলতা” তে ছোট্ট একটা চরিত্রে সুযোগ দিয়েছিলেন। অতিথি শিল্পীই বলা যায়। অবশ্য তার আগে কামু মুখোপাধ্যায় জীবনের প্রথম অভিনয় করে ফেলেছেন “সোনার হরিণ” চলচ্চিত্রে….. উত্তম কুমার, তরুণ কুমার, ছবি বিশ্বাস, সুপ্রিয়া দেবী, কালী ব্যানার্জি, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, কে ছিলো না সেই ছবিতে? তবুও নজর কেড়েছিলেন – ‘আবদাল্লা’!
অবশ্য ‘চারুলতা’য় কম স্ক্রিন প্রেজেন্সের জন্য দুঃখ করেছিলেন সত্যজিৎ রায়ের কাছে, উনি বুঝিয়েছিলেনও যে – কম সময়ে মুন্সিয়ানা দেখানোয় আসল কথা। তারপর “নায়ক” মুক্তি পেলো, ভালোই সময় পেলেন কামু, প্রীতিশ সরকার এর স্পেকট্রাম কোম্পানির কথা মনে নেই? তবে সময় অল্প হোক বা বেশি কামু মুখোপাধ্যায় মানেই দারুন স্ক্রিন প্রেজেন্স… মনে আছে ‘হীরক রাজার দেশে’ র সেই পরোয়ানা দেখতে চাওয়া রক্ষীকে? যার উদ্দেশ্যে গুপিবাঘা গাইবে – “ধরো নাকো…. সান্ত্রী মশাই….!” ঐ ছোট্ট একটা রোল, তাতেই কামাল। মগললাল মেঘরাজের ডেরার ‘অর্জুন’কে ভোলার কথা নয় কারো…. কেরামতি দেখে ‘তনখা’ বাড়িয়ে দেয় মগনলাল, সেই ছুরি ছুঁড়ে সার্কাস দেখানো লোকটার ভূমিকাতেও…..,ঐ টুকু সময়েও কি এক্সপ্রেশন! শেষেরটা ছোঁড়ার পরে কোমর ধরে বসে পড়লেন, গোটা শরীরে পদকের ঝনঝন আওয়াজ। শোনা যায় “সোনার কেল্লা” তে একটা দৃশ্য বাদ দেওয়া হয়েছিলো। ‘মন্দার বোস’এর দুঃসাহসিক অভিযানের স্বাক্ষর ছিলো সেটা, খালি বোতলে বিছে ধরার দৃশ্য, সম্পাদকের কাঁচিতে যেটা জায়গা পেয়েছিলো, তাই দুঃখ করেছিলেন তিনি তার প্রিয় মাণিকদার কাছে। আসলে ঐ দৃশ্য একদম সত্যিই ছিলো। এমনই খল – ছল চরিত্রে তাঁর আদবকায়দা শিক্ষনীয় বিষয়।
অভিনীত চরিত্রগুলি যেমন বিচিত্র ছিলো তেমনই ছিলো তার অভিব্যক্তি। এমনি কি আর “ফটিকাচাঁদ” এ হারুন-অল-রশিদ বা ‘হারুন’ ভরসা হয়ে ওঠে ফটিকের…. জাগলার হারুনই বোধহয় কামু মুখোপাধ্যায়কে সবচেয়ে বেশি সময় দিয়েছিলেন নিজেকে মেলে ধরার, তাই তো এ চরিত্র বোধহয় সবচেয়ে বেশি প্রিয় সিনেমাপ্রেমীদের। ‘শাখা প্রশাখা’ তে মজুমদার বাড়ির লোকদের দেখা শোনার ভার তার ওপরেই, কতটুকু সময় আর? “সোনার কেল্লা”, “নায়ক” বা “ফটিকচাঁদ” এ কামুকে যতটুকু সুযোগ দিতে পেরেছেন সত্যজিৎ – সন্দীপ রায় মিলে…. ততটাও অন্যান্য পরিচালকরা তাদের সিনেমায় ব্যবহার করতে পারেননি। তবে যত স্বল্প সময়েরই রোল হতো কামু পর্দায় আসলেই একটা আলাদা ভালো লাগা ছিলো। কি তার চাহনি, কি তার সংলাপ ছু্ঁড়ে দেওয়া – সবেতেই যেন সব সময় একটা চ্যালেঞ্জের ছাপ। সত্যজিৎ রায় মারা যাবার পর তাঁর মরদেহের পাশে বসে অঝোর নয়নে কেঁদেছিলেন কামু, সর্বজনবিদিত সে কথা। কাঁদবেন নাই বা কেন — মাণিকদার মতো তাকে কেউ সাহায্য করেননি যে! বলে না ‘জহুরি তে জহর চেনে’, একদম সে রকমই ব্যাপার। কামুর সাহস আর অকুতোভয়ের ওপর ভরসা করে সত্যজিৎ রায় তাকে ইচ্ছেমতো রোল দিতে পারতেন, ছোট্ট একটা চরিত্রে কম সময় হলেও তাকে দিয়ে খুশি করার চেষ্টা করতেন৷ “গুগাবাবা ট্রিলজি” র সব সিনেমাতেই তিনি আছেন কিন্তু চিনতে গেলেই হার মেনে যাবো আমরা। যেমন “গুপি বাঘা ফিরে এলো” তে ‘হুঁশিয়ার, হুঁশিয়ার’ বলে দৌড়ে যাচ্ছে গুপি আর বাঘা, পালকির ভেতরে এক রাজা আঙুর খেতে খেতে স্তব্ধ। মনে আছে নিশ্চয়? ভেবে দেখেছেন কি ঐ ছোট্ট একটা দৃশ্য, তাও কতটা স্মরণীয়, সৌজন্যে – অবশ্যই কামু মুখোপাধ্যায় ! “শতরঞ্জ কি খিলাড়ি” তেও আছেন। অন্যান্য পরিচালকরা তেমন উড়তে দেননি তাকে, সে “হংসরাজ” ছবিতে ‘দালাল’ হোক্ বা গৌতম ঘোষের “পার” ছবিতে পাটকলে কাজ দেওয়া ‘সর্দার’ এর চরিত্র – সবকটায় ছোটো, তবে ফ্রেমে এলেই আলাদা করে দৃষ্টি আকর্ষণ করে নেন।
ফটিকের হারুন…
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত একটা সুযোগ দিয়েছিলেন, তার ”ফেরা” চলচ্চিত্রে, নাট্যদলের মালিকের ভূমিকায়। জমিয়ে দিয়েছিলেন, “মৌচাক” সিনেমাতেও, ঐ দেড় মিনিট – সুপারভাইজারের মাথা ম্যাসেজ করতে দেখবেন। বাংলা সিনেমাতে চরিত্রাভিনেতাদের রমরমা চিরকালই, নায়কদের ছাপিয়ে তারা জায়গা করে নেন। কিন্তু এই কামু ব্রাত্যই থেকে গেলে, স্বল্প সময়ে ওরকম স্ক্রিন প্রেজেন্স দিয়েও অন্যান্য বাঘা বাঘা পরিচালকরা তাকে সুযোগ তেমন দিতে আর পেরেছিলেন কোথায়? সে কথা টের পেয়েওছিলেন তিনি, নিজে মজা করে বলতেনও সে কথা – “মন্দার বোসের বাজার মন্দা”! সত্যজিৎ রায় খুব ভালোবাসতেন তার ‘মন্দার বোস’ কে। উনি মারা যাবার পর সেভাবে কামু মুখোপাধ্যায় সুযোগ পেলেন না, সন্দীপ রায়ও মনে রাখেননি। বাংলা চলচ্চিত্র জগৎ তখনই হারিয়ে ফেললো প্রতিভাবান, অসমসাহসী এই অভিনেতাটিকে, যিনি বারবার দুঃখবোধ করেছেন স্বচ্ছন্দে জায়গা না পাওয়ার জন্য…. অথচ দেখুন কোনো নায়কের অভিনয়ে তাঁর অভিনীত চরিত্র ঢেকে যায়নি, যে চরিত্রে অভিনয় করেছেন সেই নামও কেউ কেউ এখনও মনে রেখেছেন, এটা হয়? এই অসম্ভবকে সম্ভব করতে পেরেছিলেন কামু মুখোপাধ্যায়। আজ তাঁরই জন্মদিন। বাংলা চলচ্চিত্র জগতের স্বর্ণযুগের প্রতিভাবান এবং প্রভাবশালী অতিথি শিল্পীকে তাই প্রণাম জানাই।
“মানুষের কতরকমের যে উদ্ভাবনী শক্তি এবং প্রয়োজন৷ আর এতো অক্লান্ত উদ্ভাবনী শক্তি আছে বলেই এত উলটোপালটা প্রয়োজন।”
— অক্ষয় মালবেরি পড়া শেষ করলাম।
এমন উপন্যাস পড়তে পারলে দারুন আরাম লাগে।মনের…! প্রশান্তি, বলা ভালো। আমাদের মানুষদের একটা দারুন মিল প্রায় সবার মধ্যেই রয়েছে সকলেই জীবনে একবার হলেও শৈশবে ফিরে যাওয়ার বাসনা প্রকাশ করে। হয়তো একাধিকবার!
শৈশবে ফিরে যাওয়া তো সম্ভব নয়৷ কিন্তু বই পড়তে পড়তে তেমন স্বাদ যদি মেলে….!
প্রকৃতি যেখানে মানুষের রূপ পায় আর মানুষের মধ্যেই প্রকৃতির সৌন্দর্য – মণীন্দ্র গুপ্ত কি স্বতঃস্ফূর্ততার সাথে বইটি পড়িয়ে নিলেন। আহামরি উৎকণ্ঠা অনুভব করিনি পড়তে পড়তে তবুও মনে হচ্ছিলো যে এ বই যত জলদি শেষ করবো তত জলদি জানতে পারবো লেখকের কি গতি হলো!
পার্থিব জগতের বস্তুগুলির তুলনাগুলি কি সুন্দর লেগেছে, সে বলে বোঝানো সম্ভব নয়। সত্যি বলতে চুপচাপ বসে থাকতে ইচ্ছে করে, বসেও ছিলাম। কতবার যে শৈশবে ফিরে গিয়েছি। না জানি, বয়স্ক মানুষরা পড়লে তাদের কি হাল হবে! এক অফুরান আনন্দে হয়তো কেউ থামতেই পারবেন না। ছোটোবেলাটা যে কত সুখের, সেটা উপন্যাসের তৃতীয় বা শেষ পর্বে এলেই বোঝা যায়! কারণ পড়তে তুলনামূলক ভালো লাগে না অথচ লেখকের কোন দোষ নেই। তিনি কি সুন্দর সব গল্প বলেছেন আমাদের। পাঠক কি না, খিদে একটু বেশিই! কেউ কেউ চতুর্থ পর্বের জন্য অপেক্ষা করেন, চিঠি পাঠান, অবশ্য তার সম্ভাবনার কথা তিনি অঙ্কুরেই বিনাশ করেছেন।
বারবার পড়তে ইচ্ছে করে যেন মালবেরির অপার্থিব গন্ধ পাই পাতা থেকে। পড়তে পড়তে স্তব্ধ হয়ে ভেবেছি — আহ! এমনটাই তো হয়েছিলো! বয়সকালে গিয়ে ফেলে আসা শৈশবের কাহিনী লেখাটা কতটা কষ্টের আবার আনন্দেরও সে বলাই বাহুল্য! সত্যিই সে জীবন ‘অক্ষয়’! এই উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ বলে মনে করি আমি।
এর চেয়ে বেশি কিছু বলার ধৃষ্টতা আমার নেই বা আরও পড়তে হবে দু’বার অনুভূতি টনটনে করার জন্য। শব্দ জানলাম বেশ কয়েকটি, নতুন। পরে হয়তো সাহায্য করবে এই ‘অক্ষয়’ই!