হঠাৎ করেই হংসেশ্বরী…

কথায় আছে যে খায় চিনি, যোগায় চিন্তামণি….

আসছি সে কথায়। সেদিন একটা পরীক্ষা ছিলো ব্যারাকপুরে, শ্রীরামপুরের ফেরী ঘাট থেকে ফেরী ধরেই জাস্ট নদী পেরোলেই ব্যারাকপুরে আমার গন্তব্য মানে পরীক্ষার সেন্টার! ব্যারাকপুরের ইতিহাস বিজড়িত ধোবিঘাট। মঙ্গল পাণ্ডের ব্যারাকপুর। প্রথম যখন সেন্টার জানতে পারি, সেকি আনন্দ! গুগল ম্যাপে সার্চ করতেই সে জানিয়ে দিলো শ্রীরামপুর রাজবাড়ির গন্ধ পাওয়া যেতে পারে, তারপর ব্যান্ডেল চার্চ, ইমামবারা তো আছেই, আরও কত কি! আমার বাড়ি থেকে এই জায়গা গুলো যদিও খুব দূর নয়, তবুও কখনো যাওয়া হয়ে ওঠেনি, কতবারই তো ইচ্ছে হয়েছিলো। তবে সেদিন সবকিছু ছাড়িয়ে একদম দূরে বাঁশবেড়িয়ার হংসেশ্বরী মন্দির চলে গিয়েছিলাম। বহুদিন থেকে তক্কে তক্কে ছিলাম। বহু লোভ ছিলো সে জায়গা ঘুরে দেখার। প্রথম দর্শনে হ্যারি পর্টারের ক্যাসেল মনে হয়েছিলো, কিম্বা কোনো চার্চ হবে হয়তো। এমন রকমের নির্মাণ শৈলী আগে কখনো চোখে পড়েনি কিনা! শ্রীরামপুর থেকে ব্যান্ডেল তো কাছেই, উদ্যোম ছিলো, দূরের জায়গাতেই আগে যাবো। বাঁশবেড়িয়া তে নেমে একটা টোটো ধরে যখন মন্দির পানে গেলাম, টোটো টা এমন জায়গায় নামালো যে সেখান থেকেই বেমালুম ফটোগ্রাফি করা যায়। মন্দির চত্বরটা এতো সুন্দর প্ল্যানিং করে বানানো যে দারুন ফটোগ্রাফি করা যায়। রাজবাড়ি সংলগ্ন মন্দির। রাজফটক আজ প্রায় ধ্বংসের মুখেই! রাজবাড়ি তে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। দূর থেকেই তাকে নিরীক্ষণ করতে হলো। মন্দির চত্বরে স্ট্রিট লাইট গুলো দেখে মনে হলো সত্যি যেন কোনো ফ্রেঞ্চ বা ব্রিটিশ কলোনিতে পৌঁছে গিয়েছি।

কলোনি যেন…
রাজফটক
স্ট্রিট লাইট
আবছা

আগে কস্মিনকালেও এমন দেখিনি, সাজানো গোছানোও নয়। সবেতেই কিন্তু পুরনো দিনের গন্ধ লেগে আছে। মন্দির প্রবেশের কিঞ্চিৎ পূর্বে একটা জলাশয় পড়ে, বোঝায় যায় রাজবাড়ি আর মন্দির সবই একটা সময়ে পরিখা দ্বারা আবৃত ছিলো, বহিরাক্রমণ থেকে রক্ষার্থে। তবে মন্দিরের সামনে গিয়ে দেখে আমি স্তম্ভিত। ক্যাসেলের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়৷ হংসেশ্বরী এখানে আরাধ্যা দেবী। উপনিষদে হংস মানে জ্ঞান বা আলো। এসব নিয়ে আর কথা বাড়াচ্ছি না৷ প্রথমে নজর কেড়ে নিলো মন্দিরের চূড়াগুলো। পদ্মের নয়নাভিরাম কারুকাজ দৃষ্টি সরাতে দেয় না। মন্দিরের গর্ভগৃহে দেবীর মূর্তি একদমই অন্যরকম৷ শায়িত মহাকালের হৃদপদ্মে মা অধিষ্ঠাত্রী। মূর্তি টি সম্ভবত কাঠের হবে, পরে পড়ে জানলাম দারুমূর্তি অর্থাৎ নিমকাঠের তৈরী। দেবী হংসেশ্বরী যেখানে উপবিষ্টা সে আসনটি অভিনবত্বে ভরপুর, না দেখলে বোঝা মুশকিল।

জগজ্জননী হংসেশ্বরী
অনন্ত বাসুদেব এর মন্দির থেকে
পরিখার এপার থেকে
রাজবাড়ি এবং মন্দির

যাই হোক্ এই মন্দিরটি ১৪ টি শিব মন্দির দিয়ে চারদিক দিয়ে ঘেরা, মনে হয় যেন এই চতুর্দশ শিব ই দেবীর প্রহরী। মন্দিরটি নির্মাণ কাজ শুরু করেন রাজা নৃসিংহদেব রায়, ১৭৯৯ সালে কিন্তু ১৮০২ সালে তিনি মারা গেলে অসমাপ্ত থেকে যায় নির্মাণ কাজ, তাঁর বিধবা পত্নী রানী শঙ্করী ১৮১৪ সালে নির্মাণ শেষ করেন। ঘুরতে ঘুরতে খিদে পেয়ে গেলো, ভাবলাম খাবোটা কি! দেখি খিচুরি প্রসাদ খাচ্ছে কয়েক জন, ঠাকুর মশাই কে গিয়ে বলতে উনি চল্লিশ টাকার বিনিময়ে একটা পার্সেল করে দিলেন, তাতে খিচুরি, বাঁধাকপির তরকারি, পায়েস, চাটনি আর পাঁপড়….৪০ টাকায় একদম উদরপূর্তি করে প্রসাদ খেলাম, একেই বলে “যে খায় চিনি যোগায় চিন্তামণি….”

অনন্ত বাসুদেব এর মন্দির

এতোক্ষণ অনেকটা সময় মন্দিরকে দিলাম এবার একটু পাশের মন্দিরে আসি…
মন্দির সংলগ্ন আর একটি মন্দিরও রয়েছে, এক টুকরো বিষ্ণুপুর যেন। অনন্ত বাসুদেবের মন্দির। মন্দিরটির পাদদেশে প্রতিষ্ঠা ফলক থেকে বুঝলাম ১৬০১, পরে বই পড়ে বুঝলাম সেটা শকাব্দ অর্থাৎ ১৬৭৯ খ্রীস্টাব্দ। রাজা রামেশ্বরদেব রায় মহাশয় এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। কষ্টিপাথরে নির্মিত বাসুদেবের উজ্জ্বল মূর্তিটি এক সময়ে অপহৃত হয়। একটা দারুন তথ্য পেলাম বইটা থেকে, সেটা হলো ভারতবর্ষের বেশ কিছু জমিদার নবাব, বাদশা, সম্রাট ইত্যাদি উপাধি পেলেও একমাত্র বংশবাটী পরিবার বা জমিদাররাই ‘রাজা মহাশয়’ উপাধি পেয়েছিলেন ১৬৭৩ খ্রীস্টাব্দে মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব কর্তৃক সনদ তা-ই বলে। রামেশ্বর দেব ছিলেন তৎকালীন জমিদার।

এক ঝলক টেরাকোটা

মন্দির প্রাঙ্গণটি অসম্ভব সুন্দর। বসে শুয়ে দিব্যি কয়েক ঘন্টা আরামে কাটিয়ে দেওয়া যায়। বেশ ভিড়েও ছিমছাম লাগছিলো কেমন একটা। সব দেখে শুনে এবার, বেরিয়ে আসবো, রাজবাড়ি দেখে লোভ হলো, কিন্তু সে জায়গায় প্রবেশাধিকার নেই, সুতরাং দূর থেকেই……!

রাজার বাড়ি


একটা বোর্ডে মন্দির নিয়ে লেখা আছে, পড়ছি! ১৩ টা চূড়া যে আছে সেটা তখনও খেয়াল হয়নি। ভুল করে ১১ টা গুনে ছিলাম, হাতঘড়ি জানান দিলো ট্রেন এখনো এক ঘন্টা দেরী। সুতরাং, আবার চললাম। এবার হিসেব বললো – নাহহহ ১৩ টাই হবে। হংসেশ্বরী মন্দিরে বিভিন্ন সময়ে পা পড়েছে অসংখ্য গুণীজনের…. রবি ঠাকুর, নন্দলাল বসু, নিয়মিত আসতেন স্বামীজী! রামকৃষ্ণদেব এসেছেন, পদধুলি পড়েছে স্বয়ং ইন্দিরা গান্ধীরও যখন তিনি নন্দলাল বসুর ছাত্রী ছিলেন।

আসলে প্রতিটি রাজ পরিবার এবং তার মন্দিরের সাথে অসংখ্য লোকগাথা, লোকাচার জড়িয়ে রয়েছে, সব কিছু অতি অল্প শব্দবন্ধে ব্যক্ত করা মুশকিল…. আপাতত এইটুকুই হয়তো হংসেশ্বরী মন্দিরে ঘুরতে আসার জন্য প্রেরণা জোগাবে….তবে দারুন ভাবে কয়েক ঘন্টা কেটে যাবে….!

বামদিকে অনন্ত বাসুদেব মন্দির এবং ডানদিকে হংসেশ্বরী মন্দির

পুনশ্চঃ আমি এটা লিখতে গিয়ে একটি বইয়ের সাহায্য নিয়েছি, মন্দিরের পুরোহিত শ্রী তপন চট্টোপাধ্যায়ের ”জগজ্জননী হংসেশ্বরী”…..মন্দির চত্বর থেকেই কিনেছিলাম। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সবই আছে তাতে! তবে এবার নারায়ণ সান্যালের ‘হংসেশ্বরী’ উপন্যাসটা পড়ে ফেলতে হবে, যে বইটা লেখকের কাছে অনুপ্রেরণা ছিলো, নইলে এমন সুন্দর একখানা বই থেকে আমার মতো ভবঘুরে মার্কা লোকজন বঞ্চিত গোবিন্দদাস হয়েই থেকে যেতো…!

পথনির্দেশ – হাওড়া থেকে ট্রেন ধরে বাঁশবেড়িয়া স্টেশন এসে টোটো ধরলেই পৌঁছে দেবে….!

© শুভঙ্কর দত্ত || Apr 5,2023

One thought on “হঠাৎ করেই হংসেশ্বরী…

Leave a comment