শিক্ষকতার এক সপ্তাহ আর অনুভূতি…

বেশ কিছুদিন আগে LUNANA বলে একটা সিনেমা দেখেছিলাম, ভূটানের সিনেমা, সম্ভবত, অস্কারে গিয়েছিলো সেরা ইন্টারন্যাশনাল ফিল্মের ক্যাটাগরিতে। একজন টিচারের গল্প। হাজারো প্রতিকূলতা কে জয়ের গল্প ছিলো সেটা, পোস্টিং ছিলো একদম পাহাড়ের ওপর। যেদিন আমার জয়েনিং লেটার এলো, আমি দেখলাম Tamenglong, Manipur, গুগলের স্মরণাপন্ন হতেই বুঝলাম এটা সেই Lunana সিনেমার পাহাড়ি স্কুল নয়তো! আসলে এই স্কুলটা নবোদয় স্বীকৃত Very hard and difficult station, মোটামুটি তিনটে কারণে এমনটা হয়ে থাকে। প্রথমত, যোগাযোগ ব্যবস্থা। দ্বিতীয়ত, আবহাওয়া আর তৃতীয়ত, জল এবং খাবার! এখানে তিনটে কারণই Very hard হওয়ার জন্যে উপযুক্ত। তবে Difficult হচ্ছে খাবারের জন্যে….! উত্তর-পূর্ব ভারতের খাদ্যাভাস আমাদের কাছে এতোটাই অজানা যে কি বলবো! ইম্ফলে পৌঁছে Laxmi Kitchen এ খেতে গিয়েছিলাম, মণিপুরের স্পেশাল ডিশ দেবে বলে কে জানতো, তাতে একটা থালায় ভাত দিলো, আর তার চারপাশে এগারোটা বাটিতে এগারো রকমের সবজী, আচার ইত্যাদি, ইত্যাদি। কোনটা খাবো, কোনটা খাবো না, কেনই বা খাবো, আর কেনই বা খাবো না! বুঝতে গিয়ে দম বেরিয়ে গেলো, মনে হচ্ছিলো খাওয়ার উপায় জানতে হলে ইউটিউবের দ্বারস্থ হতে হবে! যাই হোক্, ইম্ফলে আমাদের এক রাত বেশি থাকতে হলো কারণ ড্রাইভাররা গ্রিন সিগন্যাল পাচ্ছিলেন না, আমরা ইম্ফলের পৌঁছানোর আগের দিন থেকেই সেখানে হঠাৎ করে ঝামেলা দানা বাঁধতে শুরু করে, সুতরাং রাস্তা সেফ ছিলো না, তাই অগত্যা! আসলে মণিপুরের রাজধানী শহরে দু’রাত কাটিয়ে যেটা বুঝলাম, এখানকার অবস্থা সত্যিই খুব একটা ভালো নয়। লড়াই অনেকটা গভীরের সমস্যা নিয়ে। সে সব থাক।

The ornaments of the hills…
From the school

বারান্দা থেকে

Touching the hills…
পাহাড়ী পথের বাঁকে

roadside view on the way to Tamenglong from Imphal

ইম্ফল থেকে তামেঙলঙ আসার সময় বুঝলাম, কেন যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো নয়, পুরোটাই পাহাড়ি রাস্তা, না, আমাদের সোনার বাংলার পুরুলিয়া বা দার্জিলিং এর মতো পাহাড়ি রাস্তা নয়, এ রাস্তার কিছু অংশ এখনও পঞ্চত্বপ্রাপ্তি হয়নি। এরকম অ্যাডভেঞ্চারাস রাস্তা দিয়ে আসার সময় বেশ কয়েকবার শিহরণ দিয়ে দেয় শরীরে….! সর্পিল পাহাড়ি পথের বাঁকে বাঁকে মেঘেদের আনাগোনা, কোথাও কোথাও তো মেঘ ভেঙে যাচ্ছি মনে হলো। সরু একটা রাস্তা, কর্দমাক্ত তার ওপরে, ড্রাইভারের বদন্যতায় শর্টকাট রুট পার হয়ে গেলাম। পার হয়েই অসীমের উদ্দেশ্যে প্রণাম! বাপরে, বাপ্! পাঁচ ঘন্টার রাস্তা পেরিয়ে বুঝতে পারলাম কতটা সুবিধাজনক জায়গাতে আমরা থাকি, সেটা আরো ঠাহর হলো এখানে এসে পৌঁছানোর পরে। একদম পাহাড়ের ওপরে একটা স্কুল। সকালে উঠে রোজ দেখি পাহাড় গুলো সারিবদ্ধ হয়ে বিরাজমান, সাদা তুলোর মতো ঘন মেঘরাশি ছড়িয়ে ছিটিয়ে তাদের কোলে….! পাহাড়ের গায়ে শিরার মতো বিছিয়ে আছে সবুজশ্রেণী।  মোবাইল ক্যামেরা আর চুপ থাকে কি করে?

মেঘেরা গোলমাল না করলে রোজ এমনই দৃশ্য মেলে রুম থেকে পা বাড়ালেই…..

ঐ একটাই জিনিস রোজ সকালে অনেক তাড়না দিয়ে দেয়, হাসিমুখে মেনে নিই সব অসুবিধা। সকাল থেকে মেঘ গুলো বেশিরভাগই পাহাড়ের কোল ঘেঁষে থাকে, সময় যতই যায়, যতই বেলা বাড়ে, মেঘ গুলো উপত্যকায় বৃষ্টি দিতে দিতে আরও ক্লান্ত হয়ে পড়ে, ”কমলো মেঘেদের ওজন” হলেও কি হবে, হালকা হয়ে পাহাড়ের ওপরে উঠে আসে , কিন্তু অধঃক্ষেপণের জন্যে তখনও তার মধ্যে বেঁচে আছে যথেষ্ট বারিকণা…..! ঠিক বেলা ১২ টা হলেই অঝোর ধারায় শুরু হয়ে যায়….!  আসলে এখানে আবহওয়া খুবই অনিশ্চিত৷ কখন শুরু কখন শেষ কেউ জানে না। আর সমতলের ছাতায় কিচ্ছুটি হবার নয়। এমনিতেই মেঘের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। ২০-৩০ মিটার দূরের জিনিসও আবছা হয়ে যায়।

Remedial class এ যাওয়ার সময়
Rain can’t stop anything here

অফিসের ওয়াই-ফাই এর অপেক্ষাতে থাকতে হয়েছিলো বেশ কিছুদিন, প্রথম দু’দিন মেলেনি, তারপর পেয়েছি, তারপর শুনলাম একদম নীচের দিকে একটা স্যারের রুমের আশেপাশে আসামের নেটওয়ার্ক ধরে নেয়, ব্যাস্ খোঁজাখুঁজি শুরু। এরকম করেই একদিন ধরে ফেললাম আসামের জিও টাওয়ার, আর তাতেই চললো নেট৷ আমার কোয়ার্টারের ঠিক বাইরে গেলেই জিওর নেটওয়ার্ক ফুল,তার মানেই এটা মণিপুরের, আর চৌকাঠ পেরিয়ে জাস্ট বসে পড়লেই আসামের নেটওয়ার্ক, দুটো কাঠি হলেই নেট অন, ওয়াটসআপ এ টুকটক টা হয়ে যায়। বেশ শান্তি আছে বিষয়টার মধ্যে, ব্যক্তিগত পরিসরটা মেলে, নইলে সারাদিনের ক্লান্তির পরে ঐ অবসরটা স্ক্রল করেই কেটে যেতো। এদিক দিয়ে ভালোই! গোটা ক্যাম্পাসটা আসলে পাহাড়ের ওপরে, আর ধাপে ধাপে বিভিন্ন হস্টেল গুলো… নীলগিরি, উদয়গিরি, আরাবল্লী, শিবালিক….. মাঝে ডাইনিং হলটা, খাওয়ার জন্যে ওপরে চড়তে হয়, স্কুল যেতে আরও ওপরে চড়তে হয়, আবার স্কুল থেকে যাওয়ার সময় নীচে নামতে হয়…. বিনে পয়সায় মধ্যপ্রদেশ কমানোর এতো সহজ উপায় আর মিলবে? তার ওপর ঘাম দিচ্ছে না একটুও….! বেলা বাড়তে বাড়তে যখন অপরাহ্নে এসে পৌঁছায় তখন চারিদিকের নিস্তব্ধতা মুগ্ধ করে দেয়, দূরের পাহাড়গুলো সব কিরকম একটা রহস্যময় রঙ ধারন করে। আসলে তার যত রঙ সবই তো গাছগাছালির দৌলতে। তারপর সাঁঝ পেরিয়ে রাত নামে, নিঝুম রাতে কীটপতঙ্গের আওয়াজ স্পষ্ট শোনা যায়, আবার কোথা দিয়ে জল বয়ে যাচ্ছে, তার শব্দও, মনে হয় কেউ বুঝি হেঁটে গেলো, কিন্তু আসলে সেরকম না….পাতার আওয়াজ, বৃষ্টি পতনের শব্দ….! রাতে ঘুম নামে দু’চোখ জুড়ে, এমন ঘুম আমার কস্মিনকালেও পায় না, এখানে যেমন ভাবে ঘুম পায়, তারপরে আর একদম জেগে থাকা যায় না। তবে এখানের ওয়েদার বেশ সুন্দর, শুধু একটু lukewarm water লাগবে খাওয়ার জন্যে….!

Evening in the campus

প্রাত্যহিক কাজের জন্যে যে জল লাগে তার একটা সমস্যা আছে বটে, তবে বৃষ্টির জল ধরে নিলেই কেল্লাফতে! বৃষ্টি এখানে ধারাবাহিকভাবে পড়ে। আসলে এই শিক্ষকতার চাকরীটা করতে এসে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে। পরিবার, কাছের মানুষদের থেকে অনেকটা দূরে কিনা, যদিও নবোদয়ে কাছেপিঠে হলেও নিরুপায় ঘর আসা।

Window view…
The clouds…
sunlight enhances the beauty…
The School

তবে এই চাকরীটা আমার ভীষণ দরকার ছিলো, অন্য চাকরী নয়, এটাই। কারণ এটার জন্যে আমি যোগ্য, সেই আত্মবিশ্বাস টা ছিলো আমার। কত লোক, কত বন্ধু কত কথা বলেছে! জানতে চেয়েছে প্রাইভেট স্কুলে ঢুকছি না কেন? তবে যে যখনই কিছু বলেছে হয় ভদ্রভাবে বলেছি, নয়তো খুব রেগে ঝেড়ে দিয়েছি। আমার এই জবটা আরও একটা কারণে দরকার ছিলো, আমার মতো যারা সাবজেক্ট নিয়ে পড়ে আছে তাদের জন্যেও, তারা যদি একটু সাহস পায়, একটু ভরসা পায়! বিএড বনাম ডিএড এ বিএড হেরে গেছে, অনেকে ভাগ্যবান হয়ে মাঝখান থেকে প্রাইমারির চাকরীও পেয়ে গেছে, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের প্রাইমারির চাকরীটা আমি কোনোদিন করতে চাইনি। আমি বিএড করেছিলাম প্রাইমারির চাকরী করবো বলে নয়, হাইস্কুলের টিচার হবো বলেই। সুতরাং এই রায়ের পরে যারা হাহুতাশ করছে তাদের বলবো যদি শিক্ষক হওয়ার নিদারুণ ইচ্ছে থাকে তাহলে পশ্চিমবঙ্গ নামক অভিশাপ থেকে বেরিয়ে আসার পরিকল্পনা শুরু হোক্, সেই মতো প্রস্তুতি….! আমার অনেক বন্ধু আমার অনেক বছর আগে থেকেই সরকারি সে হোক স্টেট বা সেন্ট্রাল আর প্রাইভেট মিলিয়ে চাকরী করছে, সে সব আমায় কোনোদিন দিশাচ্যূত করেনি। আমার কখনো মনখারাপও হতো না, শুধু খারাপ লেগেছিলো যখন ২০২০ তে নোটিফিকেশন এলো বিএডরাও প্রাইমারির ইন্টারভিউ এর জন্যে যোগ্য…..কারণ ঐ একটাই পরীক্ষার অ্যাডমিট আমি গুছিয়ে রাখিনি। আজ কোনো দুঃখ নেই, রিগ্রেট নেই! কারণ ঐ জবটা আমি করতেই চাইনি। একটাই কথা বলবো কোনোদিক না তাকিয়ে চুপচাপ পড়ে যাও, লোকে অনেক কথা বলবে, মেসের বন্ধুও অনেক কথা বলবে! এতো পড়ে কি হয়, এই কটা তো ভ্যাকেন্সি! এইসবকে হেলায় হারানো সম্ভব যদি নিজে চুপচাপ কাজ করে যায়। এখন খারাপ লাগে না আর। ভালোই লাগে। অনেকটা দূরে আছি, নেটওয়ার্ক ঠিকঠাক নেই, ইন্টারনেট shut down…. খারাপ লাগছে না কিন্তু। ক্লাস করছি, দরজা ধাক্কা দিয়ে বেশ কিছু মোল মেঘ ঢুকে গেলো। ঠান্ডা লাগছে, স্বপ্নেও ভাবিনি নিজের পছন্দের কাজটা পেতে হলে এতোদূরে আসতে হবে, প্রকৃতি রোজ এসে আমাকে তার উপস্থিতি জানান দিয়ে যাবে! বাঙালি ঘরমুখো, এই মিথটা একটু একটু করে ভাঙতে হবে, নইলে ঐ পাশের বাড়ির ছেলেকে দেখে আফসোস হবে। গাল দিতে ইচ্ছে করবে শাসকদলকে, কিন্তু তাতে চাকরী মিলবে না! সকালে স্কুলে এসে যখন প্রার্থনা টা শুনি সমবেত কণ্ঠে, তখন একদম শান্তি নেমে আসে, নিজের ইচ্ছের কাজটা করতে পারার শান্তি।

Absolute.. 
Unknown though beautiful….
taking the bath…
Manipuri Dish…
Panoramic view
You have to go down…

✒️ শুভঙ্কর দত্ত || Aug 14, 2023 || Tamenglong, Manipur

One thought on “শিক্ষকতার এক সপ্তাহ আর অনুভূতি…

  1. এর থেকে আর কি চাই, জায়গাটা তো মন ছুঁয়ে যাচ্ছে ❤️

    Like

Leave a comment