শতবর্ষেও ‘জীবন্ত মানুষ’ – ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়

“মাসিমা মালপো খামু”
“ভোলা গুঁতো”
“আপনি অত্যন্ত পেট পাতলা লোক”
“আমরা গোরুর কেস করি না”
“আপনার ডাক্তার না হয়ে মোক্তার হওয়া উচিৎ ছিলো”

জন্মশতবর্ষে ”জীবন্ত মানুষ”…

বাংলা সিনেমা জগতের এরকম আরও অনেক সংলাপ দিয়ে তিনি অমরত্ব লাভ করেছেন….! আজ তাঁরই জন্মের শতবর্ষ! ২৬ শে আগষ্ট, ১৯২০ খৃষ্টাব্দে তিনি বাংলাদেশের (তখন সবটাই ব্রিটিশ ইণ্ডিয়া) মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন মোক্তার আর মা সুনীতাদেবী শিক্ষা দপ্তরের চাকরি করতেন! সরোজিনী নাইডুর আত্মীয়া তিনি আবার! অবশ্য এমন হাসাতে পারেন যিনি তার জন্ম যে পূর্ববঙ্গে হবে এমনটাই তো স্বাভাবিক, যদিও বাপ মা প্রদত্ত নাম ছিলো সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায়। “সাম্যময়” থেকে “ভানু” হয়ে ওঠার গল্পটা এতো সহজ নয় অবশ্য! হতে পারতেন অভিনেতা বাদে অন্যকিছু – স্বদেশী বা বিপ্লবী বা হয়তো পার্টির সর্বময় কর্তা কিন্তু হলেন কি? ‘কমেডিয়ান’ ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। বলতেন — ছিলাম ‘বাঁড়ুজ্জে’, হয়ে গেলাম ‘ভাঁড়ুজ্জে’…! অবশ্য শুরুটা এভাবে হয়নি। খুব ছোটবেলা থেকেই গুরু মানতেন বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত কে। ছোটবেলা থেকেই তার সাইকেলে চেপে ঘুরেছেন বিস্তর। শুধু তাই নয়, বুকের মধ্যে নিষিদ্ধ বই চেপে বা টিফিন বক্সে রিভলবার নিয়ে ঘুরেছেন, পাচার করেছেন। দীনেশ গুপ্ত মারা যাবার পর জড়িয়ে গিয়েছিলেন অনুশীলন সমিতির কাজে। তখন ঢাকার জগন্নাথ কলেজে, বিজ্ঞানী সত্যেন বসু, রমেশচন্দ্র মজুমদার বা কবি জসীমউদ্দিনের প্রিয় ছাত্র তিনি, এদিকে পুরোমাত্রায় জড়িয়ে পড়েছেন স্বদেশী আন্দোলনে, হুলিয়া জারি হল তার নামে, ছাড়তে বাধ্য হলেন বাংলা, তাও আবার এক বন্ধুর গাড়ির ব্যাকসিটের পাদানিতে শুয়ে! ভাবা যায় এ পার বাংলায় আগমণটাও তার এরকম নাটকীয়ভাবে হয়েছিলো। এরকম স্বদেশী করা লোক কর্মজীবনের প্রথম দিকে অভিনয় করে বেড়ালেন বেশ কিছু নাটকে, অতঃপর পরিচালকদের নজরে পড়েন। প্রথম ছবি অবশ্য ‘জাগরণ’, ১৯৪৭ সালে, পরিচালক বিভূতি চক্রবর্তীর ডাকে স্টুডিওতে গিয়ে হাজির। পরিচালক বলে বসলেন দুর্ভিক্ষপীড়িত চিমসে চেহারা চরিত্রে তাকে অভিনয় করতে হবে৷ জানতে চাইলেন ভানু রাজি কিনা! ভানু ‘হ্যাঁ’ করতে দেরী করেননি। আসলে তখন ভানু বেশ রোগা ছিলেন, সেটা আমরা ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ দেখলেই বুঝতে পারি। সাড়ে চুয়াত্তরেই ভানু প্রথম সাড়া ফেলে দেন, তার কারণ এক ঝাঁক নতুন অভিনেতা – অভিনেত্রীর কেরিয়ার শুরু হতে চলেছে একই ছায়াছবি দিয়ে কিন্তু ভানুর দিশি স্টাইলের কথাবার্তা তাকে আলাদা করে চিনতে বাধ্য করেছিলো। “মাসিমা মালপো খামু” – সংলাপটি তাই আজও প্রতিটা বাঙালির মুখে মুখে। রোগা চেহারার ভানু সেই প্রথম এক ঝাঁক জাত শিল্পীর মাঝেও নিজের স্বতন্ত্রতা তুলে ধরতে পেরেছিলেন, এই ছবি যদি ভালো করে দেখে থাকেন, তাহলে বুঝবেন যে একজন শিল্পী প্রতিটা আলাদা সিচুয়েশন মোতাবেক কেমন হাসাতে পারেন, এদিক থেকে তার মতো সিচুয়েশনাল কমেডিয়ান অভিনেতা বাঙালি আর দেখেনি! শুধু অভিনয় করে হাসাতেন না, বরং আজকাল ওগুলো দেখলে যেনো মনে হয় উনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন – এটাই কমেডি অ্যাক্টিং, আর পার্থক্য বুঝিয়ে দিয়েছেন ওনার হাসানো আর কাতুকুতু দিয়ে হাসানোর মধ্যে। “সাড়ে চুয়াত্তর” এ মেসের মিটিং এ কেদারের উপস্থিতি, আমার মতো মেসে থাকা পাবলিকদের কাছে আদর্শ হয়ে থাকবে বোধ হয়। এর পর বেশ কিছু ছবি করলেও, কয়েকটি ছবি আজ অমরত্ব লাভ করেছে, যেমন – ”যমালয়ে জীবন্ত মানুষ”, ”৮০তে আসিও না”, “ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট”, “ভানু পেলো লটারি”, ”পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট”, “মিস প্রিয়ংবদা”…. এর মধ্যে কিছু কিছু ছবিতে ভানুই হিরো আবার টাকাও উনিই ঢেলেছেন। কিন্তু কতগুলো কমেডি, কতগুলো রোমান্টিক কমেডি, আবার বেশ কয়েকটি ছবিতে ভানু-জহরের যুগলবন্দী আমরা দেখতে পাই।

কেদার এর চরিত্রে ভিড়ের মাঝে


“যমালয়ে জীবন্ত মানুষ” নিয়ে কথা বলতে গেলে শেষ হবে না….. স্বর্গলোকে যমালয়ে ভুল করে তুলে এনে যে কি বিপদ করেছে সেখানের কর্মীরা…!একজন জীবন্ত মানুষ ধরে ধরে ভুল ধরছেন যমরাজ থেকে চিত্রগুপ্তের…। সিস্টেম বদলাতে বদ্ধপরিকর তিনি। সহাস্যে বলছেন ‘যতদিন আছি বুঝলে বিচিত্রগুপ্ত, অপঘাতে মৃত্যু নিয়ে একটা বিহিত করে যাই…’। বিপ্লবী অনন্ত সিংহ ছিলেন ছবির প্রযোজক — তার প্রথম দুটো সিনেমা ফ্লপ করলে, ভানু তাকে বরাভয় দেন। বাকিটা আমরা দেখতে পেয়েছি, আমার তো মনে হয় সিনেমাটা যতটা রোম্যান্টিক কমেডি তার চেয়ে বেশি স্যাটায়ার! স্বর্গলোকের প্রতিটা চরিত্রের সাথে তার কথোপকথনগুলো আলাদা আলাদা ভিডিও ফাইল করে রাখতে ইচ্ছে করে…. তিনি বলছেন – “সেবাই তো আমার ধর্ম, তার ওপর আমি আবার মানুষ!” একবারও ঐ চরিত্রে ভানু ছাড়া ইহ জগতের আর কাউকেই কল্পনা করা কষ্টের ব্যাপার। সিনেমাটি অবশ্য একটি হলিউড ফিল্ম থেকে অনুপ্রাণিত কিন্তু কে ওসব মনে রেখেছে। আবার এই সিনেমাতেই ভানুকে আমরা পেয়েছি দারুন রোম্যান্টিক হিরো হিসেবে…. মাধুরী – সিদ্ধেশ্বর এর প্রেমের দৃশ্যগুলো যেমন রোম্যান্টিক, তেমনই কমেডির। তার প্রেমিকা প্রেম করতে গিয়ে ভক্তিমূলক গান গাইছে, সেখানে পাশে বসে ভানুর মুখের অভিব্যক্তি গান শোনা থেকে বিরত রাখতে বাধ্য। আবার ভানু-জহরের ঐ অপঘাতে মৃত্যু নিয়ে যে দৃশ্যটা ওটাও অসামান্য….ডুবলো কিন্তু মরলো না, অথচ সাঁতারও জানে না। উর্বশীকে নাচ শেখানোর দৃশ্য — ‘হাম হাম গুড়ি গুড়ি’ নাচ! এই সিনেমাটা দেখার পর ঐ ছোটোবেলাতেই যে এই নামটা নিয়ে কতবার হেসেছি, গুনে শেষ করা যাবে না, এমনকি এখনও! সেখানে নাচের নাম জিগ্যেস করতেই সিধুর অকপট স্বীকারোক্তি – “আগ্রহই হচ্ছে নাচের প্রধান অঙ্গ”, “নাচের একটা ভালো নাম থাকলে আর নাচতেই হয় না…”! এই জায়গাটাই চোখ ফেরানো যায় কি? যায় না।

সিধু হয়ে যমালয়ে

এরপর কথা বলতে গেলে “৮০ তে আসিও না” নিয়ে বলতে হয়, সেখানে আবার সমাজের এক অন্য রূপ, ব্যঙ্গের মাধ্যমে। এক বৃদ্ধের যুবকে পরিণত হয়ে যাওয়ার গল্প, আসলে গল্পটা কিন্তু অন্য – একজন বৃদ্ধের প্রতি তার ছেলেমেয়েদের অবহেলার গল্প। এই সিনেমাতেও ভানু আর রুমা গুহ ঠাকুরতার রসায়ন দেখার মত। “আমি এখন জল পুলিশের আন্ডারে” — এই সংলাপটিকে ভানু ছাড়া অন্য কেউ অমরত্ব দিতে পারতেন কি? মনে হয় না পারতেন বলে। আবার এ ছবিতে জহরও আছেন।

জল পুলিশের Under এ

“পার্সোনাল অ্যাসিসট্যান্ট” আরও একটা ছবি যেটা ভানুর নিজের ছবি, একদমই নিজের, রমাপদ গুপ্ত থেকে রমা গুপ্ত আর মিনতি মিত্র হওয়ার গল্প কোন্ ভানুপ্রিয় দর্শকের মনে নেই! ঐ ছবিতে মেদিনী দেবীর বাড়িতে পিয়ানো বাজানোর দৃশ্য আজও পেটে খিল ধরাতে বাধ্য, তরুন কুমার আর ভানুর বন্ধুত্বের যে সমীকরণ ছবিতে দেখতে পাই, সেটা দারুন লাগে। টাইপিং টেস্টের সময় ভানুর ভেকগুলো তীব্র হাসির উদ্রেক করে আট থেকে আশি – সবারই। এই ছবিটা অবশ্যি করার কথা ছিলো উত্তমকুমারের, কিন্তু মনমতো স্ক্রিপট না পাওয়ার কারণে তিনি সরে দাঁড়ালে ভানুর কাছে অফার আসে, লুফে নেন ভানু৷ নচিকেতা ঘোষ গান লিখে ফেলেছেন উত্তমকুমার আছে জেনে…. ভানু স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন শুনে তিনি বলেছিলেন – যা ব্বাবা, ভানু থাকবে জানলে আমি গানই লিখতাম না। অবশ্য সিনেমা দেখে প্রশংসাই করেছিলেন।
ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে গল্পের অভাব নেই। তার বাড়িতে বসতো চাঁদের হাট। কে আসতো না? উত্তমকুমার থেকে সুচিত্রা সেন, সুপ্রিয়া দেবী থেকে অনুপ কুমার, সোমিত্র চট্টোপাধ্যায়। বিকাশ রায়কে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন, উনি বাড়ি এলে নাকি ওনার পাশে বসতেন না, বসতেন পায়ের কাছে। ছবি বিশ্বাসও ছিলেন ভানুর ভীষন কাছের মানুষ, দিন দুবেলা ভেনোর বাড়ি আসা চাই-ই চাই। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবিতে ছবি বিশ্বাস আর তুলসী চক্রবর্তীকে নেওয়া একরকম বাধ্যতামূলকই ছিলো।

রমাপদ থেকে রমা হয়ে মিনতি মিত্র

তারপর ‘ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিট্যান্ট’ সিনেমাতেও সেই জুটি। বাংলা চলচ্চিত্রের জগতে কমেডি সিনেমা বললে এটা আসবেই….! আমি জানি না এরকম আসল নামেই অভিনেতার ভাগ্যে চরিত্র জুটেছে ক’জনের কপালে! ঐ ফিল্মে ‘কমলা’ তদন্ত উদঘাটনে আসা বৃদ্ধার সাথে ভানু – জহরের দৃশ্যটা দেখবার মতো। ভানুর মুখভঙ্গি আলাদা মাত্রা দেবে যখন বলবে “দুধ!, দুধ দেয়?” বা ”আমরা গোরুর কেস করি না”….. এগুলো সবই চলন্ত ফ্রেম হয়ে থাকবে!

আসল নামেই চরিত্র – অভিনয়

‘ভানু পেলো লটারি’ র প্রথমেই জহরের আগমণ আর ঐ ‘জহুরে’ বলে ডাক্ বলেই দেয় অফস্ক্রিনে তাদের বন্ধুত্বের গাঢ়ত্ব কতটা ছিলো। তখন খুব ছোটোবেলা, টিভিতে দিতো সিনেমাটা৷ ‘আমার এই ছোট্ট ঝুড়ি’ গানটাতে ভানুকে দেখার জন্যে মুখিয়ে থাকতাম, এই ছবিতে ভানুর গোঁফটাই ছবির ডিএনএ। সাথে, জহরের পাশে একফ্রেমে বাঙালির হৃদয়ে চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে। তারপর দুই ভানু সামনে আসার পর তো আরোই হাস্যকর।

ভানু তখন মধ্যগগণে…

ভানুর আরও একটি হিট ছবি “মিস প্রিয়ংবদা”, হাসির দৃশ্যের জন্য আগের ছবিগুলোর সাথেই যেটাকে স্মরণ করা হয়। বামা চরিত্রে তিনি যে বহুমুখী একটা অভিনয় করেছিলেন, সেটা দেখলেই মনে হয় কত বড় মাপের অভিনেতা ছিলেন…. তরুন কুমারের সাথে গলায় কাঁথা গলিয়ে ধূমপানের দৃশ্যটি বেশ হাস্যকর! মানে উনি যে চরিত্রটা করতেন, তাতে বাঁচতেন, আগের সবগুলোকে সেই মুহুর্তে ভুলিয়ে রাখতে পারতেন। সেরকমই একটা দৃশ্যে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন যেখানে প্রিয়ংবদা নামের মহিলা সেজে তিনি হরিধন বাবুর কাছে যাবেন তাকে পটাতে! এ দৃশ্য দেখার পর ঐ সিনেমার আগের হাসির দৃশ্য কিছুই আর মনে থাকে না।

তরুন – ভানু জুটিতেও

অনস্ক্রিনের ভানুর সেন্স অব হিউমর নিয়ে কথা বলি আমরা কিন্তু মানুষটার পর্দার বাইরের রসবোধ নিয়েও অগাধ কাহিনী আছে। ইষ্টবেঙ্গলের ভক্ত ছিলেন, শচীন দেব বর্মনের সাথে খেলা দেখতে গিয়ে তার থেকে ঝেঁপে খেয়েও নিতেন। ম্যান ম্যানেজার ছিলেন দারুন। শ্যুটিং এ তাকে দেখতে ভিড়! সামাল দিলেন ভানু! ঢাকার হস্টেলে পুজোর খাওয়া নিয়ে গোলমাল….. ভানু এলেন এগিয়ে, উচ্চকণ্ঠে ঘোষনা – কাউকে খাওয়ার দরকার নেই। রসিকতা করতেন গলা ছেড়ে…. প্রায়শই আড্ডাতে বলতেন – ‘‘আমার দশা ক্যামনে শুনেন। মা মারা গ্যাছে। শ্মশানে গেছি। চোখে জল। একটা লোক কাছে আইয়া কইল, আরে ভানুদা কী হইসে? কোনওক্রমে কইলাম, ভাই মা মারা গ্যাসেন। শুইন্যা হাসতে হাসতে চইল্যা যাইতে যাইতে কইল, ‘দ্যাখ, ভানুরে কাঁদলে কেমন লাগে!’ বুঝেন একবার! হালা, নিজে যখন শ্মশান যামু লোকে দেইখ্যা বলবে, ওই দ্যাখ, ভানুর মাথাটা কেমন নড়তাসে!’’ এইসবই তাঁর ভাগ্যবান পুত্র গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষ্যে পড়ি আনন্দবাজারে। কোলকাতা তার এতোটাই প্রিয় ছিলো যে মুম্বইয়ের ডাক প্রত্যাখান করেছেন সহজেই। গুরু দত্তের ‘পিয়াসা’ র অফার ছেড়েছিলেন। তবে বন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে ‘বন্দীস’, ‘মুসাফির’ সিনেমাতে অভিনয় করেছিলেন। আসলে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন আদ্যোপান্তো দেশীয় সংস্কৃতির মানুষ, চার্লি চ্যাপলিনের স্টাইলটাকে পুরোমাত্রায় দেশীয় স্টাইলে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। বিকাশ রায়, ছবি বিশ্বাস এরা ছিলেন ওনার দাদার মতো, গুরু মানতেন…আর জহর? লোকজন ভাবতো এদের খুব কম্পিটিশন কিন্তু একটা ঘটনা সে সব তোয়াক্কায় করতে দিলো না — ভানু গাড়ি কিনেছে, স্টুডিও তে জহর সবাইকে ডেকে বলে দিলো — ভেনোই একমাত্র যে বাংলাদেশে কৌতুক অভিনয় করে গাড়ি কিনেছে। এটা ওর একার গাড়ি নয়, ভেনো প্রতি শনিবার আমার জন্য গাড়ি পাঠাস….. শারদীয়া এই সময় এ এটা পড়েছিলাম। আর ভানু সত্যিই তেল ভরে গাড়ি পাঠিয়ে দিতেন, নিজে ব্যস্ত থাকতেন, ট্যাক্সি তে চড়তেন আর জহুরে চষে বেড়াতো শহর। ভাবা যায়! আমরা শুধু রুপোলি পর্দায় দেখেই আহ্লাদিত হয়ে যায়!

পার্শ্বচরিত্র হলেও সমানে নজর কেড়েছেন

সেই কত ছোটোবেলায় দেখেছিলাম ‘ভ্রান্তিবিলাস’, এখনও মনে আছে তার “কিংকর” চরিত্রটাকে.. ঐ নিশিতে ডাকার সিনে তার যে অভিব্যক্তি এখনও চোখে লেগে আছে। “চৌরঙ্গী”র শাজাহান হোটেলের সবাইকে ভুলে গেলেও ভুলতে পারবো না ন্যাটাহরি কে! ঐ কোঁকড়ানো চুল আর গোল চশমার ছবি দেখলে যে কেউ বলবে ওটা নিত্যহরির অবয়ব। এগুলো সবই ভানুর পার্শ্বচরিত্র কিন্তু তাতেও দাগ রেখেছেন সমানে। ‘পাশের বাড়ি’ বলে একটা ছবি করেছিলেন কেরিয়ারের প্রথম দিকে, বেশ কিছু বছর পরে হিন্দিতে ‘পাড়োসান’ হচ্ছে, মেহবুব তো ভানুর কাছে চলে এলেন পরামর্শ নিতে, একই রোল যে। সাড়ে চুয়াত্তর এর কাজ দেখে কেষ্ট মুখুজ্জে প্রায় কোলে তুলে নিয়েছিলেন।

তবে ভানুর বেশ কিছু ছবির রেকর্ড আজ আর পাওয়া যায় না। বেশ কিছু বছর আগে ‘নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে’ ছবিটির সংস্করণ উদ্ধার করা হয়, নইলে বাংলা সিনেমার দর্শক ভানুর অভিনীত সেরা সিনেমাটা দেখা থেকে বঞ্চিত হতেনই। সারা জীবন কমেডি চরিত্রেই অভিনয় করিয়ে যাওয়া পরিচালকরা বোধ হয় বুঝতে পারেননি যে উনি সিরিয়াস চরিত্রেও সমান দক্ষ এবং এই ছবি তার প্রমাণ। প্রহ্লাদ চন্দ্র ঘোষ থেকে পরাশর ঘোষ থেকে সন্ন্যাসী – চরিত্রটা ভানু অসামান্য শিল্পনৈপুণ্যতায় তুলে ধরেছেন। এই সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন ওনার নিজের মেয়ে, বাসবী বন্দ্যোপাধ্যায়, শিশু শিল্পীর চরিত্রে! এই ছবিটা দেখার পরে হয়তো অনেক দক্ষ পরিচালকই হাত কামড়ে ছিলেন ভানুর জাত সঠিকভাবে না চিনতে পারার জন্য। এই ছবির কিছু গানের তালিম হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে নিতে হয়েছিলো ভানুর স্ত্রীর কাছে, যিনি আবার নামকরা গায়িকা ছিলেন, আকাশবাণীতে গাইতেন। এই ছবির প্রথমার্ধ হাসালেও দ্বিতীয়ার্ধ যে কোনো মানুষকে কাঁদিয়ে দেবে এবং তার একমাত্র কারণ ভানুর অভিনয়।

নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়া ভানু

ভানু, উত্তমকুমার থেকে শুরু করে জহর, অনিল চট্টোপাধ্যায় এনারা ‘অভিনেতৃ সংঘ’ করেছিলেন, কিন্তু একসময় উত্তমকুমার সেখান থেকে বেরিয়ে গেলে ভানু আঘাত পান, কাজ কম পেতে থাকেন। কিন্তু কখনোই বসে থাকেননি। রেডিও তে নাটক করলেন, হাস্যকৌতুক করলেন! তার কিছু কিছু নমুনা আজ আমরা ইউটিউবে পায়। বেশিরভাগটাই হয়তো আমরা সংরক্ষণ করতেই পারিনি। বেশ কয়েকবার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পরে মারা যান ১৯৮৩ তে! মারা যাওয়ার পরের বছর তার শেষ অভিনীত সিনেমাটি মুক্তি পায় – শোরগোল। শুধু আক্ষেপ একটাই শুধুমাত্র কমেডিয়ান হয়েই রয়ে গেলেন। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় এমনই একজন শিল্পী যিনি প্রতিটি চরিত্রে বেঁচেছেন, উত্তরসূরীকে শিখিয়ে গিয়েছেন কমেডি অ্যাক্টিং আসলেই কি, যিনি আদ্যোপান্ত বুঝিয়ে দিয়েছেন – দেশীয় সংস্কৃতিটাকে নিজের মধ্যে দিয়ে জনমানসে বাঁচিয়ে রাখার মাহাত্ম্যটাও শিল্প, যিনি বরাভয় জুগিয়েছেন পরিচালকদের মনে অথচ কত সহজ সরল এবং স্বতন্ত্র ভঙ্গিমায় নিজের হিট ছবিগুলো পর পর দিয়ে গেছেন….. জন্মশতবর্ষে এসেও তাই তিনি প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে বেঁচে আছেন…..আসলেই তিনি “জীবন্ত মানুষ” !

ব্যক্তিগত জীবনে ‘ভানু’

সাহায্য — ১. শারদীয়া এই সময় (১৪২৬)
২. আনন্দবাজার পত্রিকার ” পত্রিকা” সংস্করণ

© শুভঙ্কর দত্ত || August 26, 2020