“ধীরে চলনা হ্যায় মুশকিল তো জলদি হি সহি…..”
সত্যিই এই ক’দিন যা চলেছি, তাতে এই লাইনটাই মনে পড়ছে! পূর্ব-পশ্চিম মেদিনীপুর, হুগলী, পূর্ব-পশ্চিম বর্ধমান, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, মালদা, দক্ষিন – উত্তর দিনাজপুর, দার্জিলিং — মোট এগারো খানা জেলার অক্সিজেন আরাম করে নিয়েছি বলা চলে! যাই হোক্ কোত্থেকে শুরু করবো এই দ্বন্দ্বের অবসান ঘটালো ঐতিহাসিক স্থানের প্রতি আমার আকুণ্ঠ পিপাসা! আপাতত “মুর্শিদাবাদ” দিয়ে অর্থাৎ যাত্রা শেষ দিয়ে শুরু হোক্ ব্লগে জল দেওয়া।
দার্জিলিং যাত্রা শেষ করে সমতলে নামছি। কথা ছিলো শুধু হাজারদুয়ারী দেখা হবে কিন্তু হাতে খানিকটা সময় আর ভ্রমণপিপাসু কিছু বাঙালি একজোট হলে যা হয়, তারপর আবার দর কষাকষির পর মোটামুটি একটা ইয়ে হতেই চলো ‘এ’ – এক্কাগাড়ি ঐ ছুটেছে……..
প্রথমেই গেলাম হাজারদুয়ারীর পাশের রাস্তা দিয়ে, আজিমুন্নেসা বেগমের জীবন্ত সমাধি।
বাংলার প্রথম নবাব মুর্শিদ কুলি খান এর কন্যা ছিলেন আজিমুন্নেসা বেগম। জনশ্রুতি রয়েছ, কঠিন রোগে আক্রান্ত হওয়ায় নবাবি হেকিম দৈনিক একটি মানবশিশুর কলিজা দিয়ে ওষুধ তৈরি করে দিতেন। অসুখ সেরে গেলেও তিনি মানবশিশুর কলিজায় নেশাগ্রস্ত হয়ে গোপনে নিয়মিত ভাবে শিশুদের কলিজা খেতে থাকেন। এই ঘটনা মুর্শিদকুলি খাঁ জানতে পেরে তাকে জীবন্ত কবর দেওয়ার নির্দেশ দেন। মুর্শিদাবাদ ঘুরতে গিয়ে টাঙ্গার (এক্কাগাড়ি বা টমটম) চালকের কাছে এমন কথা শুনে সত্যিই চমৎকৃত হয়েছিলাম। একতলা পাকা মঞ্চের উপর মসজিদে উঠার সিড়ির নিচে আজিমুন্নেসার সমাধি, যে মসজিদটা তৈরী করিয়েছিলেন মুর্শিদকুলি খাঁ এর কন্যা স্বয়ং! মঞ্চের উপরিভাগে বাম পাশে একটা দেয়াল ছাড়া মসজিদের আর কোন চিহ্ন বর্তমানে নাই। কথিত আছে সাধারণ মানুষের পদধূলিতে তার শিশু হত্যার পাপ মোচনের জন্য মসজিদে উঠার সিড়ির নিচে তাকে জীবন্ত সমাহিত করা হয়।
তারপর একই রাস্তা ধরে দক্ষিণে শর্টকাট নিয়ে চলে গেলাম কাঠগোলা বাগানবাড়ি। তবে কাঠগোলা তে পরম প্রাপ্তি হলো ওখানকার ছান্দসিক গাইড দাদা, এতো সুন্দরভাবে বলে গেলেন খিদে তিষ্টা কোনদিকে উড়ে গেলো।
লক্ষীপৎ, জগপৎ, মহীপৎ ও ধনপৎ । হাজারদুয়ারি থেকে ৪ কিমি উত্তরে চার ভাইয়ের এই কাঠগোলা বাগান। ১৭৮০ সালে কাঠগোলা বাগানের প্রতিষ্ঠতা করেন লক্ষীপৎ সিং দুগর। প্রায় ২৫০বিঘা জায়গা নিয়ে বিশাল বাগানের মধ্যে দোতালা অট্টালিকার সামনে বড় পুকুর খনন করা হয়। সেই পুকুরে থাকত নানা ধরনের রঙ্গীন মাছ। নবাব সৈয়দ হাসান আলী মির্জা কাঠগোলা বাগানের নাচ মহলে অংশ গ্রহণ করতেন। এখানে জৈন মন্দির ও প্রাসাদ ছাড়াও রয়েছে চিড়িয়াখানা, হেরেম ও শ্বেত পাথরে বাঁধানো পুকুর। এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন ধরনের মহামূল্যবান আসবাব ও তৈজসপত্র।
কাঠগোলা নামটি আসলে কাঠগোলাপ এরই অপভ্রংশ বলা যায়। সেকালে প্রচুর কাঠের আসবাবপত্রের ব্যবসা ছিলো আর ছিলো গোলাপের বাগান। সেখান থেকেই এই নাম।
বহুদিন এ প্রাসাদ বন্ধ বা পরিত্যক্তই ছিলো বলা যায়। ১৮৭০ সালে এ প্রাসাদটি আবার পুনর্নির্মান করা হয়। লক্ষীপৎ সিং দুগরের বংশধর সঞ্জয় সিং ও সিদ্ধার্থ এখন এর দেখাশোনা করেন। কথিত আছে, কাঠগোলা বাগানের পূর্বদিকে যে প্রাচীন মসজিদ ও কবরস্থান আছে সেখানকার এক ইঁদারার কাছ থেকে দুগড় পরিবার প্রচুর গুপ্তধন পেয়েছিলেন। প্রাপ্ত সব টাকায় তারা বাগান সাজাতে ও মন্দির নির্মাণ করতে খরচ করেছিলেন।
সেকালে কাঠগোলা বাগানে জলসা হতো এবং অনেক লোকের সমাগম হতো। বর্তমানে কাঠগোলা বাগান একটি দর্শনীয় স্থান। অট্টালিকা, সংগ্রহশালা, গোপন সুরঙ্গপথ, আদিনাথ মন্দির, বাঁধানো পুকুর সব কিছু নিয়ে মুর্শিদাবাদের এই দর্শনীয় স্থানটি অতুলনীয়।
এরপর জগৎ শেঠ এর বাড়ি।
জগৎ শেঠ বাংলার অত্যন্ত ধনী ব্যাংকার ফতেহ চাঁদকে আঠারো শতকের প্রথমার্ধে ‘জগৎ শেঠ’ বা বিশ্বের ব্যাংকার উপাধি প্রদান করা হয়। জগৎ শেঠ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মানিক চাঁদ। তিনি আঠারো শতকের প্রথম দিকে পাটনা থেকে ঢাকা আসেন এবং এখানে একটি বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। বাংলার দেওয়ান মুর্শিদকুলী খানতার রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর করলে, মানিক চাঁদ তার সাথে নতুন রাজধানীতে চলে যান। মুর্শিদাবাদে তিনি ছিলেন নওয়াবের খুবই প্রিয়ভাজন এবং পরে নওয়াবের ব্যাংকার ও অর্থনৈতিক উপদেষ্টার পদ লাভ করেন। দিল্লির সিংহাসনে আরোহণের পর পরই সম্রাট ফররুখ সিয়ার ‘নগর শেঠ’ (নগরের ব্যাংকার) উপাধি প্রদান করে মানিক চাঁদকে সম্মানিত করেন। ১৭১৪ সালে মানিক চাঁদের মৃত্যুর পর তার ভ্রাতুষ্পুত্র (দত্তক পুত্র) ও উত্তরাধিকারী ফতেহ চাঁদের নেতৃত্বে পরিবারটি বিপুল খ্যাতি অর্জন করে। পরে সম্রাট মাহমুদ শাহ ফতেহ চাঁদকে ‘জগৎ শেঠ’ উপাধি প্রদান করলে এ ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানটি দেশে এক অনন্য মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে এটি পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণের একটি স্থাপনা ও জায়গা। জগৎ শেঠের বাড়ি মুর্শিদাবাদ শহরতলীর অদূরে নশিপুর এলাকাতে আরেকটি ঐতিহাসিক স্থাপনা এখনো কালের স্বাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে তা হলো নবাবী আমলের ধর্নাঢ্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তি জগৎ শেঠের বাড়িটি। সেখানে জগৎ শেঠদের ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিস ও আসবাবপত্র রয়েছে। বাড়ির ঠিক পিছনে রয়েছে ভূগর্ভস্থ গুপ্ত সুরঙ্গ, মাটির তলায় গুপ্ত ঘর। রয়েছে জগৎশেঠের টাকশালে তৈরি স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা, স্বর্ণ ও রৌপ্য শাড়ি, খাজঞ্চি খানা, ঢাকাই মসলিন ও তৎকালিন ব্যবহার্য্য বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শণ সমূহ। বাড়ির আঙিনায় রয়েছে বিশাল একটি মন্দির।
জগৎ শেঠের বাড়ির বিভিন্ন অংশ
এরপর রাস্তায় আসতে আসতে চোখে পড়লো নসিপুর রাজবাড়ী যার অনুকরণে হাজারদুয়ারী তৈরী হয়েছে।
নসিপুর রাজবাটী তে কেন তার ঘোড়াকে থামতে বললো না চালক, তা বুঝলাম না। অদূরেই রঘুনাথজীউ মন্দির/আশ্রম ছিলো বলেই হয়তো!
ফরাগঞ্জের দেবোত্তর ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানটি মুর্শিদাবাদের একটি ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা। এটি মুর্শিদাবাদ পৌরসভা কর্তৃক ঘোষিত একটি ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য। আনুমানিক ২৫০ বছর আগে এই স্থাপনাটি নির্মিত হয়। বাংলা ১১৬৮ সালে মহন্ত লছমন দাস ঢাকার উর্দু বাজার থেকে এসে মীর জাফরের আদি বাড়ি সংলগ্ন স্থানে এই জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানটি স্থাপন করেন। তবে রঘুনাথ মন্দিরটি বেশ চমকপ্রদ, উপরের দিকে আঁকা আছে একদিকে সিংহ আর একদিকে ঘোড়া, মাঝে ঢালের মতো….নীচে লেখা পলাশীর যুদ্ধ। বিস্তৃত এই জায়গায় আছে প্রাচীন কাষ্ঠ শিল্পে খোদিত এবং রাজস্থানের তুষারশুভ্র মর্মরে শতাধিক বছরের প্রাচীন প্রাসাদ। বয়সের ভারে প্রাসাদটি আজ জরাজীর্ণ অবস্থা। এটি বন্ধই থাকে। পাশের ভবনে আছে ঐতিহ্যবাহী সোনার রথ, বেলোয়ারী ঝাড়, ঐতিহ্যময় আসবাবপত্র, প্রাচীন যুগের বেবি অস্টিন মোটর যান, পুরনো রান্না সরঞ্জাম ইত্যাদি। কথিত আছে, প্রাচীন যুগের এই বেবি অস্টিন গাড়িটি আশি টাকা দিয়ে কেনা হয়েছিল, যা আজ ছোট একটি গ্যারেজে রাখা আছে। পাশেই আছে সোনার রথ। দর্শনার্থীদের জন্য দিনের সব সময়ই এটি খোলা থাকে।
রঘুনাথ মন্দিরের বিভিন্ন দর্শনীয় বিষয়সমূহ
বেশ কয়েকটা জায়গা তাড়াহুড়োর সাথে দেখতে দেখতে যখন ক্লান্ত তখন এক্কাগাড়ির চালক হাজারদুয়ারী নিয়ে বলতে শুরু করেছেন, আমরাও গল্প করে যাচ্ছি, ভদ্রলোক রেগে গেলেন। আমরা আবার মনোনিবেশ করলাম। বস্তুত বলে রাখি, অনেকেই হয়তো জানে হাজারদুয়ারী সিরাজের তৈরী, এটা ভাবা বেশ বড়ো ভুল। তৈরী তো নয়ই, বরং উনি কখনো এই অপূর্ব স্থাপত্যটিকে দেখে যেতে পারেন নি জীবনকালে। চালক ই তো জীবন্ত জিপিএস এর মতোই….বলে চলেছেন–
১৮৩৭ সালে নবাব নাজিম হুমায়ুন খাঁয়ের জন্য ৮০ ফুট উঁচু তিনতলা গম্বুজওয়ালা এই প্রাসাদ অর্থাৎ হাজারদুয়ারূ নির্মিত হয়। আদপে ৯০০টি দরজা হলেও আরও ১০০টি কৃত্রিম দরজা রয়েছে প্রাসাদে। তাই নাম হাজারদুয়ারি। প্রাচীন মুর্শিদাবাদের স্মৃতি নিয়ে অপরূপ গথিকশৈলীর এই প্রাসাদ এখন মিউজিয়াম। আক্ষরিক অর্থেই এ এক ঐতিহাসিক জাদুঘর। নীচের তলায় রয়েছে তৎকালীন নবাবদের ব্যবহৃত প্রায় ২৭০০টি অস্ত্রশস্ত্র। যার মধ্যে আলিবর্দি ও সিরাজের তরবারি এমনকী যে ছুরিকা দিয়ে মহম্মদি বেগ সিরাজকে খুন করেছিল তা পর্যন্ত রক্ষিত আছে এই সংগ্রহশালায়। এই সুরম্য বিশাল রাজপ্রাসাদের দ্বিতলে দেখা যায় রুপোর সিংহাসন যেটি ব্রিটিশ সম্রাজ্ঞী মহারানি ভিক্টোরিয়ার দেওয়া উপহার। ১৬১টি ঝাড়যুক্ত বিশাল ঝাড়বাতির নীচে সিংহাসনে বসে নবাব দরবার পরিচালনা করতেন। মন্ত্রণাকক্ষের লুকোচুরি আয়না, দেশ-বিদেশ থেকে সংগৃহীত বিশ্ববিখ্যাত সব ঘড়ি, মার্শাল, টিশিয়ান, রাফায়েল, ভ্যান ডাইক প্রমুখ ইউরোপীয় শিল্পীর অয়েল পেন্টিং, প্রাচীন সব পাথরের মূর্তি হাজারদুয়ারিকে বিখ্যাত করে তুলেছে। ত্রিতলে আছে নবাবী আমলের ঐতিহাসিক নিদর্শন সোনা দিয়ে মোড়া কোরাণ শরিফ, অমূল্য পুঁথিপত্র, আইন-ই-আকবরির পান্ডুলিপি সহ অসংখ্য বইয়ের সম্ভার। ভারতের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ইতিহাসেরও কিছু বিশিষ্ট নিদর্শন সংরক্ষিত রয়েছে এই মিউজিয়ামে। হাজারদুয়ারির চত্বরে রয়েছে ১৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে জনার্দন কর্মকারের তৈরি ১৮ ফুট লম্বা, আট টন ওজনের ‘জাহানকোষা’ কামান বা বিশ্বজয়ী কামান। এই কামানে একবার তোপ দাগতে ৩০ কেজি বারুদ লাগত বলে জানা যায়। এটি বাচ্চেওয়ালি কামান নামেও পরিচিত।
তবে সবকিছু দেখার পরেও গুগল ম্যাপে একটি বার চোখ রাখলেই অনেক কিছু স্পষ্ট হয়ে যায়। এক পাগল হকার আমাদের বলছিলো – ‘এটা মীরজাফর এর এলাকা, গদ্দারী কে করবে না?’ লোকটা বলছিলো – ‘এই শালারা সেখানেই ঘুরতে নিয়ে যাবে যেখানে ঢুকতে টাকা লাগবে, তোমরা চলো, আমি ঘোরাবো গোটা মুর্শিদাবাদ, টাকা লাগবে না!’ বলতে বলতে দেখলাম একজন তেড়ে এলো! এ ঘটনা ঘোরাঘুরির অব্যবহিত পূর্বেই। যদিও তার আগেই সকাল সকাল বাস থামতেই ভাগীরথী নদী, ফেরী ঘাট আর ওয়াসিফ আলি মির্জার বাড়িটা দেখে নিলাম।
ওয়াসিফ ভবনের বিশেষ বিশেষ অংশ
ও বলা হয়নি, ভগ্নপ্রায় মীরজাফরের বাড়িটা পড়লো কাঠগোলা আসতে আসতে….. কিন্তু স্রেফ একটা দেওয়াল, এক্কাগাড়ির ঘোড়াটাও দাঁড়ালো না, হয়তো ওরও খেয়াল আছে….ওটা “নিমকহারামের দেউড়ী”…
তথ্যসূত্র : এক্কাগাড়ির চালককাকু এবং অবশ্যই ঈশ্বররূপী গুগল
© শুভঙ্কর দত্ত || রামজীবনপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর // April 9, 2018